নারায়ণগঞ্জে মৃত স্কুলছাত্রীর জীবিত ফিরে আসার ঘটনাকে পুরো পুলিশ বাহিনীর গায়ে মাখানোর দরকার নেই বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে বিচ্ছিন্নভাবেই দেখা উচিত। যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে তাহলে সেটা থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটানো যায়, সেটা পুলিশ বাহিনীর ভেবে দেখা উচিত।
এ ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর শুনানিতে বুধবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এমন মন্তব্য করেন।
হাইকোর্ট আরও বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যদি পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় কোনো ব্যক্তিকে কোনো কটু কথা পর্যন্ত বলা হয়, তাহলে সেটা অপরাধ হিসেবে দেখা হয়।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন। তার সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারোয়ার হোসেন। অন্যদিকে আবেদনকারী পাঁচ আইনজীবীর পক্ষে শুনানি করেন মোহাম্মদ শিশির মনির। সাবেক তদন্ত কর্মকর্তার পক্ষে ছিলেন মনসুরুল হক চৌধুরী।
শুনানিত সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, বিচারিক তদন্ত কমিটির রিপোর্টে পুলিশ বাহিনীর ওপর একটা দোষ দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অতিরঞ্জিত কিছু করেননি। তিনি তার আওতার মধ্যে থেকেই আসামি গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়েছেন। আসামিদের কোনো নির্যাতন করা হয়নি। কারণ আসামিরা জুডিসিয়াল কমিটির বাইরে আর কারও কাছে নির্যাতনের কথা তুলে ধরেননি।
তখন আদালত বলেন, জবানবন্দিতে আসামিরা যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটা সত্য নয়। ভিকটিমকে মেরে নদীতে ফেলার যে জবানবন্দি তাতে আসামিদের স্বার্থ কী? এদেশের মানুষ ক্ষুদিরামের ফাঁসি দেখতে চেয়েছিলো। এজন্য কি সবাই ফাঁসিতে যেতে চায়? এ বিষয়ে আমাদের একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
হাইকোর্ট বলেন, আমরা বিচারপতি। আমরা এই মাটির সন্তান। আমরা সব কথা কোর্টে বলতে পারি না। এখানে শুনানির সময় সাংবাদিকরাও থাকেন। ফাঁসি হবে জেনেও আসামিরা কি স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিয়েছেন? জবানবন্দিতে আসামিরা মেয়েটিকে হত্যা করার কথা তাহলে কি শখ করে বলেছেন? এটা দুর্ভাগ্যজনক। অভাগা তো হলো এদেশের জনগণ।
এ পর্যায়ে মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, ভিকটিম বিচারিক কমিটির কাছে বলেছেন আসামি আবদুল্লাহ তাকে ধর্ষণ করেছেন। আদালত বলেন, ২২ ধারায় জবানবন্দিতে মেয়েটি আদালতে কী বলেছেন? দুটো জবানবন্দির মধ্যে কোনটিকে আমরা ঠিক মনে করবো?
শুনানিতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মো. সরোয়ার হোসেন বাপ্পী বলেন, আসামিরা রিমান্ডের পর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দি দেয়ার সময় তারা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নির্যাতনের কথা বলেননি। আদালত বলেন, আপনাদের দুই জনের শুনানি গ্রহণ করলে আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সত্য বলে ধরে নিতে হয়।
মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা ভিকটিমকে উদ্ধার করেছেন, সেজন্য জুডিসিয়াল রিপোর্টে তার প্রশংসাও করা হয়েছে। এই মামলায় তদন্ত কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করা ঠিক হবে না। তদন্ত কর্মকর্তা শামীম আল মামুনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হোক।
এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিনকে উদ্দেশ করে আদালত বলেন, ভারতে কোনো আসামিকে রিমান্ডে নেয়া হলে সেখানে আইনজীবী রাখার সুযোগ আছে। সেজন্য তারা সিআরপিসি সংশোধন করেছে। আমাদের তো কোর্ট থেকে আইন সংশোধনের কথা বললে নানান প্রতিক্রিয়া হয়।
মনসুরুল হক চৌধুরী বাংলাদেশ বনাম ব্লাস্ট মামলার উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, এই মামলা বলে দেয় রিমান্ডে আইনজীবী রাখার সুযোগ আছে।
তখন অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এই মামলাটি এখন রিভিউ বিচারাধীন রয়েছে। সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল বিভাগকে এ বিষয়ে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তখন আদালত বলেন, হাইকোর্টের কাজ কি তাহলে রুল মঞ্জুর, রুল খারিজ করা আর জামিন দেয়া?
এ পর্যায়ে রিভিশন মামলার আইনজীবী মো. শিশির মনির বলেন, ব্লাস্ট বনাম রাষ্ট্র মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে যে রিভিউ চাওয়া হয়েছে সেখানে রিমান্ডে আইনজীবী রাখার বিষয়ে কোনো বিরোধিতা করা হয়নি। পরে আদালত এই মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ২০ জানুয়ারি দিন ধার্য করেন। ওই দিন অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শুনবেন আদালত।
এর আগে নারায়ণগঞ্জে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় আসামিদের স্বীকারোক্তি আদায় সংক্রান্ত সদর থানার কার্যক্রমের বিষয়ে বিচারিক তদন্ত প্রতিবেদন গত ৪ জানুয়ারি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় দাখিল করা হয়।
গত ৪ জুলাই নারায়ণঞ্জে ৫ম শ্রেণির ছাত্রী দিসা নিখোঁজ হয়। এ ঘটনায় দিসার বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় অপহরণ মামলা করেন। মামলার পর পুলিশ আবদুল্লাহ, রকিব এবং খলিল নামে তিনজনকে গ্রেফতার করে। তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
স্বীকারোক্তিতে জানান, তারা স্কুলছাত্রী দিসাকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেন। জবানবন্দি গ্রহণের পর আসামিদের জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু গত ২৩ আগস্ট দিসাকে খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ঘটনায় পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে তদন্ত কর্মকর্তা আসামিদের মারধর, ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ ও খুনের স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করেন। তবে প্রকৃতপক্ষে এই তিনজন ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়।
এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় করা মামলা এবং মামলা পরবর্তী প্রক্রিয়ার শুদ্ধতা, বৈধতা, যৌক্তিকতা ও মামলার নথি তলব চেয়ে গত ২৫ আগস্ট পাঁচ আইনজীবী হাইকোর্টে আবেদন করেন। পরে সাবেক তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করলে তিনি হাজির হয়ে ১৭ সেপ্টেম্বর ব্যাখ্যা দেন। গত ২৪ সেপ্টেম্বর বিচারিক অনুসন্ধানে নারায়ণগঞ্জের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতি আদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।