খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ) নামেই উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। অবৈধ নিয়োগ, প্লট ভাগাভাগি, উন্নয়নকাজে গতিহীনতাসহ নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে সংস্থাটি। অভিযোগ উঠেছে, সংস্থাটি জনগণের প্রতিষ্ঠান হলেও দুর্নীতিগ্রস্ত ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ফলে সংস্থাটির ওপর ক্ষুদ্ধ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিক ও নাগরিক নেতারা । তারা বলেছেন, খুলনার উন্নয়নে কেডিএ কোন ভূমিকা রাখছে না। দিনের পর দিন উন্নয়ন প্রকল্প বরাদ্দ এলে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ফলে সাধারণ মানুষ যেমন দুর্ভোগে পড়ছে, তেমনি সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে যায়, ১৯৬১ সালে খুলনার পরিকল্পিত উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ) প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু সংস্থাটি খুলনার পরিকল্পিত উন্নয়নে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু তাই নয়, এটি একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরে সচিব ড. মোহাম্মদ শাহানুল আলম, সিনিয়র বৈষয়িক কর্মকর্তা ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (অ:দা) শামীম জেহাদ, নির্বাহী প্রকৌশলী (পূর্ত) মো. আরমান হোসেন এই শীর্ষ তিন কর্তার দাপটে অনেটাই অসহায় অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ফলে প্রতিটি কাজে সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে। সর্বশেষ সংস্থাটির পরিচালক (প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা) ড. মোহাম্মদ শাহানুর আলম ৫ জন কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। এদের মধ্যে আলিম উদ্দিন, মো. ইমানুল হোসেন, মো. কাওছার মাহমুদকে বৈষয়িক শাখায়, মো. আসাদুজ্জামানকে তত্ত্বাবধায় প্রকৌশলীর দপ্তর ও মো. আসাদুল্লাহ সরকারকে স্থপতির দপ্তরে কাজ করবেন। কেডিএ’র চাকুরি নীতিমালা লঙ্ঘন করে এ চাকুরি দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
কেডিএ’র তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে নগরীর পশ্চিম সিটি বাইপাস সংলগ্ন আহসানাবাদ মৌজায় ৯০ একর জমিতে ‘ময়ূরী’ নামে একটি আবাসিক প্রকল্প গড়ে তোলে কেডিএ। এ আবাসন প্রকল্পে মোট ৬৫৩টি প্লট রয়েছে। এর মধ্যে ৩ কাঠার ৩৮৪ ও ৫ কাঠার প্লট ২৬৯টি। প্রকল্পের শুরুতে ৩ কাঠা প্লটের প্রতি কাঠা ৯ লাখ টাকা এবং ৫ কাঠা প্লটের জন্য সাড়ে ৯ লাখ টাকা দাম নির্ধারণ করা হয়। কোঠা অনুযায়ী লটারীর মাধ্যমে এসব প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়। ইতিমধ্যে অনেকে ২৭ ও সাড়ে ৪৭ লাখ মূল্য পরিশোধ করে নির্ধারিত প্লট গ্রহণ করেছেন। তবে নানা কারণে আবেদন বাতিল হওয়ায় ৫ কাঠার ১৬টি ও ৩ কাঠার ১৫টি প্লটের বরাদ্দ বাকি রয়েছে। গেল ২০ ডিসেম্বর এগুলোই মাত্র ৫ লাখ টাকা কাঠা হারে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অনিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বরাদ্দ দিয়েছে কেডিএ। অথচ ভূমি উন্নয়ন ও প্রকল্পের কাজ এখন প্রায় ৭০ ভাগ শেষে প্রতি কাঠা জমির বাজারমূল্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ লাখ টাকা। নীতিমালায় আগে দাখিল করা আবেদনকারীরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্লট পাবেন বলা হলেও তা মানা হয়নি। আবার দুই ক্যাটাগরির ৬৫৩ প্লটের মধ্যে বিক্রি করা ৬২১টি প্লটের একটিও রেজিস্ট্রি না হলেও ভাগবাটোয়ারা করে নেয়া প্লটগুলোর রেজিস্ট্রি কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
সংস্থার ৫ কাঠা প্লট বরাদ্দের তালিকায় উল্লেখ্যযোগ্যদের মধ্যে রয়েছেন সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট গ্লোরিয়া ঝর্ণা, কেডিএ’র সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ আবদুল মুকিম সরকার, সাবেক চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অব. আহমেদুল কবীর, কেডিএর পরিচালক ড. মোহাম্মদ শাহানুর আলম, পরিচালক এস্টেট মো. ছাদেকুর রহমান, সহকারী প্রকৌশলী মুনতাসির মামুন। তালিকায় রয়েছেন একাধিক সচিব ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কমকর্তারাও। তিন কাঠার প্লট পাওয়া থেকে বাদ যাননি কেডিএ’র অফিস সহকারী, অংকনবিদ, মসজিদের ইমাম, বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি এমনকি পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তাকর্মীও। অবশ্য এসব ব্যক্তিদের তিনজনে মিলে ৩কাঠার প্লট পেয়েছেন।
কেডিএর বোর্ড সদস্য আকরাম হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, বোর্ড সভায় আলোচনার সুযোগ কোথায়। আগে থেকে সব সিদ্ধান্ত কমপ্লিট করে মন্ত্রনালয়ের সচিব, সচিবের পিএস, এপিএস এর নামে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
খুলনা সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি তালুকদার আব্দুল খালেক এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করে বলেন, কেডিএ’র গড়ে তোলা সোনাডাঙ্গা প্রথম ফেজ, দ্বিতীয় ফেজ, নিরালা, মুজগুন্নী ও ফুলবাড়িগেট আবাসিক এলাকা অপরিকল্পিত। ওই এলাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, স্যানিটেশন ও বিনোদন ব্যবস্থা নেই। বরং সরকারি খাল-নালা দখল করা হয়েছে। সামন্য বৃষ্টিতে এসব এলাকায় জলবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। মানুষ দুর্ভোগের শিকার হয়। ২০১৩ সালে একনেকে পাস হওয়া খুলনার শিপইয়ার্ড চারলেন সড়ক, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়-বাইপাস সড়ক বাস্তবায়ন হয়নি। শিপইয়ার্ড সড়কের প্রায় ৯৯ কোটি টাকার ব্যয় বেড়ে এখন ২৬৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ময়ূরী আবাসিক এলাকার প্লটদাতাদের কাছ থেকে চক্রবৃদ্ধি সুদ আদায় করা হয়েছে। সংস্থাটি ব্যাংকে টাকা রেখে সুদ খাওয়ায় ব্যস্ত। তছাড়া কেডিএ নির্মিত নগরীর সবগুলো সড়ক বেহাল অবস্থা ও নিম্নমানের। যার দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে খুলনাবাসীকে। খুলনার এই জনপ্রতিনিধি এর আগে সংস্থাটির বিরুদ্ধে আন্দোলনের হুসিয়ারী দেন।
জনউদ্যোগ খুলনার সদস্য সচিব মহেন্দ্র নাথ সেন বলেন, ‘কেডিএ খুলনা অঞ্চলের মানুষের কোন উপকারে আসছে না। এটি একটি বাণিজ্যিক ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তাদের কোন কাজ নেই। প্রকল্পের টাকা রেখে সুদ নিচ্ছে। প্লট বরাদ্দে নামে গ্রাহকদের কাছ সুদসহ উচ্চমূল্য নিচ্ছে। কোন প্রতিবাদই কাজে আসছে না। সরকারের এ বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া জরুরী। না হলে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে।
পরিচালক (প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা) ড. মোহাম্মদ শাহানুর আলম বলেন, যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তারা অস্থায়ী। কাজ না করলে টাকা পাবেন না। আমি মিটিংয়ে রয়েছি; অন্যান্য বিষয়ে পরে কথা বলবো।