ভুল নকশায় নির্মাণ করা হয়েছে যশোর-খুলনা মহাসড়কের পালবাড়ী থেকে রাজঘাট অংশ। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়নি, এরই মধ্যে বিভিন্ন স্থানে রাস্তা ঢেউয়ের মতো উঁচু-নিচু হয়ে গেছে। অর্থাৎ রাস্তার বিভিন্ন অংশ ফুলে গেছে, যাকে রাটিং বলা হয়। এ থেকে সৃষ্টি হচ্ছে খানাখন্দের। এর সমাধানে ফের পিচ ঢালাই করেও ফল মেলেনি। আবার রাটিং দেখা দিয়েছে। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও নজরে এসেছে। এতে ‘বিব্রত’ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।
এ অবস্থায় প্রকল্পের নকশা, সমীক্ষা ও উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) ভুলের জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছে মন্ত্রণালয়। বলা হয়েছে, ভুল নকশার পাশাপাশি প্রকল্পের সমীক্ষাতেও ভুল ছিল। সড়কটিতে যতসংখ্যক গাড়ি চলবে বলে ধারণা করা হয়েছিল এর চেয়েও বেশি চলছে। অতিরিক্ত ওজনের বাহনও চলছে। এসব কারণে ৩২১ কোটি টাকায় ৩৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগে রাটিং সৃষ্টি হয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী, সড়কের নতুন করে ভিত তৈরিতে সাড়ে চার থেকে পাঁচ ফুট গর্ত করে প্রথমে বালি ফেলা হয়। পরে বালি ও খোয়া এবং শেষে বালি ও পাথর মিশিয়ে ভরাট করতে হয়। এর পর বিটুমিনের পাঁচ ইঞ্চি পুরু ঢালাই দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজের ক্ষেত্রে এসব নিয়ম মানেনি। পুরনো সড়ক খুঁড়ে তোলা ইট-বালি ফের ব্যবহারেরও অভিযোগ রয়েছে। অবশ্য এসব অভিযোগ পর্যালোচনা সভায় ওঠেনি। গত ১৩ জানুয়ারি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে অনুষ্ঠিত সভায় বলা হয়, আগে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন আশানুরূপ নয়। মন্ত্রণালয়ের সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ প্রকল্পের পর্যালোচনায় বেরিয়ে আসে নানা তথ্য। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) কর্মকর্তাদেরও দায় চিহ্নিত করেছে মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়, সড়কের নকশা পর্যালোচনা করা হয়নি। নবনির্মিত সড়কে রাটিং সমস্যার সমাধানে গত বছর বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. মো. জাকারিয়াকে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি পরিদর্শন করে সমস্যা সমাধানে বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দেন। এর পরও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এ ছাড়া গত জুলাইয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবদুল মালেক প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন। তিনি ১৩ জানুয়ারির সভায় বলেন, ৩৮ কিলোমিটার সড়কের দুটি প্যাকেজের কাজ ভালো হলেও সাত কিলোমিটার অংশে ‘ওয়্যারিং কোর্স’-এর ওপর রাটিং দৃশ্যমান হয়েছে। সড়কের কাজ শেষ হওয়ার আগেই রাটিং সৃষ্টি খুবই উদ্বেগজনক।
মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে বলা হয়েছে, দুই লেনের যশোর-খুলনা জেলা সড়কের পালবাড়ী থেকে রাজঘাট অংশটি চার লেনের জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত করা হয়েছে ভুল নকশায়। রাস্তাটি জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত হলেও নকশা করা হয়েছে জেলা সড়কের জন্য প্রযোজ্য ‘বাইন্ডার্স কোর্স’ অনুযায়ী। অর্থাৎ জেলা সড়কের সক্ষমতা রয়েছে সড়কটির। প্রকল্পের সমীক্ষাতেও ভুল ছিল। রাস্তাটি দৈনিক যে পরিমাণ গাড়ি (অ্যানুয়াল অ্যাভারেজ ডেইলি ট্রাফিক- এএডিটি) চলাচল করবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছিল, বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি যানবাহন চলছে। সড়কে রাটিং সৃষ্টির আরেকটি কারণ অতিরিক্ত পণ্য নিয়ে চলাচল করা গাড়ি। কিন্তু এমন গাড়ির চলাচল ঠেকাতে ওই সড়কে ‘ওয়ে স্কেল’ নেই।
সভায় সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (কারিগরি সার্ভিস উইং) ড. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, যে কোনো নকশা পর্যালোচনা এবং মাঠপর্যায়ে কাজের উপযোগী না হলে তাৎক্ষণিক রোড ডিজাইন ও সেফটি সার্কেলকে অবহিত করা উচিত। অথচ যখন সমস্যা সৃষ্টি হয়, তখন সমাধানের জন্য আসেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। যখন রাটিং সমস্যা দেখা দেয়, তখনই ফুলে উঁচু হয়ে যাওয়া অংশ মিলিং মেশিন দিয়ে কেটে উপযুক্ত উপকরণ ব্যবহার করে সমাধান করাতে হবে। কারিগরি সমাধান এমন হতে হবে, যাতে সড়ক টেকসই হয়।
তবে সওজের যশোর বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, অতিরিক্ত পণ্যবাহী যান চলাচলের কারণে সড়ক বেহাল হয়েছে। ওভারলোড গাড়ি চলাচল বন্ধ করা না গেলে সড়ক টেকসই হবে না। অতিরিক্ত পণ্যবাহী গাড়ি ঠেকাতে সড়কের প্রবেশমুখে স্থায়ী ‘এক্সেল লোড’ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র প্রয়োজন।
২৪ ফুট প্রশস্ত দুই লেনের যশোর-খুলনা জেলা সড়ককে ৩৪ ফুট চওড়া চার লেনের জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত করার কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের মে মাসে। প্রকল্পটির ঠিকাদার মাহবুব অ্যান্ড ব্রাদার্স ও তমা কনস্ট্রাকশন। আগামী জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে। এ পর্যায়ে এসে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে ডিপিপি পর্যালোচনা সভায়। সমস্যা সমাধান না করে প্রকল্প শেষ করা হবে না। ফলে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি নিশ্চিত। পর্যালোচনা সভায় সিদ্ধান্ত হয়, সংশোধিত ডিপিপি ৫০ কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। অর্থাৎ প্রকল্প ব্যয় ৩৭০ কোটি টাকায় দাঁড়াচ্ছে।
মন্ত্রণালয়ের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, সড়কের প্রবেশমুখে স্থায়ী এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপনের আগ পর্যন্ত অতিরিক্ত পণ্যবাহী যান চলা বন্ধে জরুরি ভিত্তিতে বহনযোগ্য ওয়ে স্কেল স্থাপন করতে হবে। অতিরিক্ত মাল বহনকারী যানবাহনকে জরিমানা করতে হবে। ভবিষ্যতে দুপাশে ধীরগতির যান চলাচলের সার্ভিস লেনের জন্য জায়গা রেখে ডিপিপি সংশোধন করতে হবে। পরামর্শকের নির্দেশনা অনুযায়ী রাটিং মেরামত করতে হবে। সড়কের দুই পাশে হার্ড শোল্ডার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সওজের কারিগরি সার্ভিস উইং পরিদর্শন করে ফের নকশা করবে। প্রকল্পটির সমীক্ষা, নকশা ও ডিপিপি প্রণয়নে যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাদের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে এবং কোন নতুন সড়কে রাটিং হয়েছে এর জবাব দিতে হবে তাদের। সূত্র : আমাদের সময়।