করোনা মহামারির ভয়াবহ বছর ২০২০ পেরিয়ে ২০২১। রোগ-শোক-মৃত্যুতে বিপর্যস্ত এই দেশ নতুন বছর শুরু করে মহামারি রোধে মারণাস্ত্র, ভ্যাকসিন পাবার আশায়। খুব বেশি দেরি করতে হয়নি। নতুন বছরের মাত্র ২৭তম দিনেই করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন মহাযজ্ঞ শুরু করতে প্রস্তুত বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে প্রায় ৭০ লাখ ভ্যাকসিন পৌঁছে গেছে ঢাকায়। ওষুধ প্রশাসনের অধিদপ্তরের পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হয়েছে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে আনা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন। প্রস্তুত হাসপাতাল ও প্রশিক্ষিত টিকাদানকারীরাও।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার (২৭ জানুয়ারি) বিকালে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভ্যাকসিনেশন বা টিকাদান কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন। প্রথমে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের একজন নার্সসহ ২৫ জনকে। স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সাংবাদিকদের মধ্যে থেকে তাদের বাছাই করা হয়েছে। এরপর বৃহস্পতিবার ঢাকার পাঁচটি হাসপাতালের ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে টিকা দেওয়া হবে,সে প্রস্তুতিও ইতোমধ্যে সেরে ফেলা হয়েছে।
এর আগে ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সারা দেশে টিকাদান শুরুর কথা জানিয়েছিলেন স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান। এক দিন এগিয়ে সারা দেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকাদান কার্যক্রম শুরু হচ্ছে ৭ ফেব্রুয়ারি। পরিবর্তিত এই তারিখের কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
করোনার ভ্যাকসিন-
প্রাথমিক পর্যায়ে ৩ কোটি টিকা আনতে গত নভেম্বরে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশি ঔষধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মার সঙ্গে চুক্তি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। চুক্তিতে বলা হয়, অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন অনুমোদন দেওয়ার এক মাসের মধ্যে সেরাম ইনস্টিটিউট ৫০ লাখ ভ্যাকসিন সরবরাহ করবে বেক্সিমকোর মাধ্যমে। এরপর প্রতি মাসে ৫০ লাখ করে ভ্যাকসিন দেবে। এভাবে মোট তিন কোটি ভ্যাকসিন কেনা হবে সেরাম থেকে।
চুক্তি অনুযায়ী, সোমবার (২৫ জানুয়ারি) বেলা ১১টার দিকে ভারত থেকে কেনা ৫০ লাখ করোনার ভ্যাকসিন এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। সেখান থেকে নয়টি ফ্রিজার ভ্যানে করে ভ্যাকসিন টঙ্গীতে বেক্সিমকোর ওয়্যারহাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে, আগে ২১ জানুয়ারি ভারতের উপহার হিসেবে ২০ লাখ ভ্যাকসিন পেয়েছে বাংলাদেশ।
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান পাপন বলেছেন, ওষুধ প্রশাসনের ছারপত্রের পর চার থেকে পাঁচদিনের মধ্যে দেশের প্রতিটি জেলায় পৌঁছে যাবে ভ্যাকসিন।
ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন-
নিয়মানুযায়ী টিকাগুলো পরীক্ষা করে দেখেছে ওষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। মঙ্গলবার (২৬ জানুয়ারি) প্রতিষ্ঠানটির প্রধান মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, কোভিশিল্ডের ৫০ লাখ ডোজ করোনা টিকা ল্যাব পরীরায় উত্তীর্ণ হয়েছে।
এই টিকা মানবদেহে ব্যবহারের উপযুক্ত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘টিকার প্রতিটি লটের নমুনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে। আগামীকাল (বুধবার) এ টিকা দিয়েই শুরু হবে করোনাভাইরাসের টিকাদান।’
প্রধানমন্ত্রীর ভ্যাকসিনেশন বা টিকাদান কর্মসূচি উদ্বোধন
বুধবার (২৭ জানুয়ারি) বিকেল সাড়ে তিনটায় করোনার টিকাদান কর্মসূচি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।প্রধানমন্ত্রী প্রথম পাঁচজনের টিকা দেওয়ার সময় ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যুক্ত থাকবেন।কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল থেকে এ অনুষ্ঠান বিটিভি সরাসরি প্রচার করবে।
ভ্যাকসিন নিতে নিবন্ধন-
প্রধানমন্ত্রীর টিকাদান কর্মসূচি উদ্বোধন অনুষ্ঠানেই চালু হবে টিকাদান ব্যবস্থাপনার ‘সুরক্ষা’ প্ল্যাটফর্মের মোবাইল অ্যাপ ও ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে নিবন্ধন কার্যক্রম। যারা টিকা নিতে চান,তাদের সবাইকেই অনলাইনে নিবন্ধন করতে হবে।
প্রথম ভ্যাকসিন নিচ্ছেন কে?
প্রথম ভ্যাকসিন নেবেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু বেরোনিকা কস্তা। তারপরে ভ্যাকসিন নিবেন আরও দুজন সিনিয়র স্টাফ নার্স মুন্নী খাতুন ও রিনা সরকার। চিকিৎসক হিসেবে প্রথম ভ্যাকসিন নেবেন মেডিসিন কনসালট্যান্ট ডা. আহমেদ লুৎফর মবিন। এছাড়া এই তালিকায় আছে আরো দুই চিকিৎসক । আর ভ্যাকসিন দিবেন সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনা আক্তার ও দীপালি ইয়াসমিন। তবে শেষ মুহূর্তে কারো কোনো শারীরিক অসুবিধা দেখা দিলে তালিকায় রদবদল হতে পারে।
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু বেরোনিকা কস্তা বিভিন্ন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, কোনো ধরনের চাপে নয়, সম্পূর্ণ নিজের আগ্রহে এই টিকা নিচ্ছেন। দুই সন্তানের জননী রুনু বেরুনিকা কস্তা ২০১৩ সাল থেকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন। এর আগে তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালে কাজ করেন। মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে নার্সিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। তার স্বামী একটি বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মী।
প্রস্তুত কুর্মিটোলাসহ পাঁচ হাসপাতাল-
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল এবং কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে টিকা দেয়ার জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় বুথ তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া টিকা প্রয়োগের পরবর্তী পর্যবেক্ষণ ও কারো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তাদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছে হাসপাতালগুলো।
পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া-
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, সব ধরনের ওষুধেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, বাংলাদেশে কোভিশিল্ড নামের যে টিকা দেওয়া হবে, তারও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে কারও কারও মধ্যে।
সেরাম ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে,এ টিকা নেওয়ার পর হালকা গা ব্যথা,শরীর গরম,লালচে হয়ে যাওয়া, চুলকানি,টিকা দেওয়ার স্থান ফুলে যাওয়া,সেখানে ক্ষত হওয়া,অসুস্থ-ক্লান্ত বোধ করা,ঠাণ্ডা বা জ্বর জ্বর লাগা,মাথা ব্যথা,বমি ভাব, জ্বর,ফ্লুর উপসর্গ- ইত্যাদি দেখা দিতে পারে কারও কারও ক্ষেত্রে।
আবার মাথা ঘোরা,ক্ষুধামান্দ্য,পেট ব্যথা,অতিরিক্ত ঘাম,লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া,ত্বকে ফুসকুড়ি ওঠার মতো কিছু অস্বাভাবিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কখনও কখনও দেখা দিতে পারে। এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে প্রতি ১০০ জনে একজনের ক্ষেত্রে। টিকা নিয়েছেন এমন ১০ জনের মধ্যে একজনের ক্ষেত্রে এসব সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
আর বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন,এখন পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে অক্সফোর্ডের টিকার মারাত্মক কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
টিকাদানের পাঁচটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, টিকা দেওয়ার পর সবাইকে আধা ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হবে,কারও কোনো সমস্যা হয় কি না দেখার জন্য। সেজন্য পোস্ট-ভ্যাকসিন এরিয়া নামে একটা জায়গা থাকবে টিকার বুথের কাছেই। সেখানে চেয়ার ও বেড থাকবে। যে যেভাবে চাইবেন,সেখানে অবস্থান করবেন। আধা ঘণ্টা অবস্থান করে তারা চলে যাবেন। যদি কারও সমস্যা হয়, অনুযায়ী আমরা চিকিৎসা দেওয়া হবে।
কারা পাচ্ছেন না ভ্যাকসিন-
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে,অক্সফোর্ডের টিকা ১৮ বছরের কম বয়সীদের ওপর পরীক্ষা করা হয়নি। এ কারণে অপ্রাপ্তবয়স্ক কাউকে টিকা দেওয়া হবে না।
গর্ভবতী নারীদের ওপর কোনো পরীক্ষা না হওয়ায় এই টিকা সাধারণভাবে তারাও পাচ্ছেন না। স্তন্যদানকারী মায়েদেরও দেওয়া যাবে না। যাদের ওষুধে অ্যালার্জি আছে,তাদের ব্যাপারেও সাবধানতা অবলম্বন করা হবে।
এছাড়া যারা কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন,তাদের টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ হওয়ার চার সপ্তাহ আগে কাউকে টিকা দেওয়া হবে না বলেও জানিয়েছে অধিদপ্তর।