“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।”-আব্দুল গাফফার চৌধুরীর বিস্ময়, বিখ্যাত, চিরস্মরণীয় এ গান ভাষার দাবীতে আত্মহুতি দেওয়া বাংলার দামাল ছেলেদের উদ্দেশ্যে। “ছেলে হারা শতমায়ের অশ্রুগড়া এ ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।” তাঁর অনবদ্য এ সৃষ্টি মায়ের মুখের ভাষা বাংলাকে রক্ষার দাবিতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে রাজপথ রঞ্জিত করা বাংলা মাতার গর্বিত সন্তান সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউরের মত সোনার ছেলেদের উদ্দেশ্যে। পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালি ছাড়া এমন কোনো জাতি নেই যারা ভাষার জন্য এমন আত্মত্যাগ করেছে। বাংলা ভাষা ছাড়া এমন কোনো ভাষা নেই য়ার জন্য কোনো জাতি বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করে মাতৃভাষাকে শত্রুদের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এ এক বিরল দৃষ্টান্ত। ভাষাকে কেন্দ্র করে বিশ্বের মানচিত্রে যে জাতির অভ্যুদয় হয়েছে সে জাতির নাম বাঙালি জাতি, সে দেশের নাম বাংলাদেশ। ভাষাকেন্দ্রিক জাতি গোষ্ঠীর উদ্ভব, বিকাশ ও অগ্রসরতার এ আকাশস্পর্শী বিস্ময়
অর্জন এর মর্মমূলে রয়েছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমি; ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির পটভূমি। তাই বাঙালি জাতির জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারি এক অবিস্মরণীয় দিন। আমার এ ক্ষুদ্র লেখনির মাধ্যমে সেই বিস্মিত ঘটনার ন্যুনতম আলোচনার দুঃসাহস ব্যক্ত করেছি মাত্র।
১৯৪৭ সাল। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ধসঢ়;র দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য এবং ভারত অধিরাজ্য নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের ছিল দুইটি অংশ।
পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তান যার বর্তমান নাম বাংলাদেশ এবং পশ্চিম পাকিস্তান। এ দুটি অংশের ব্যবধান প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারেরও অধিক। স্বাভাবিক ভাবেই এ দুটি অংশের মধ্যে সংস্কৃতি , ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্যও বিরাজমান ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের নব্য উপনিবেশবাদী, ক্ষমতালিপ্সু, উদ্ধত শাসকরা শুরু থেকেই এ দেশের মানুষের উপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাতে থাকে। প্রথমেই তারা ফন্দি আঁটে কীভাবে এ দেশের মানুষের মুখের ভাষাকে কেড়ে নেওয়া যায়। এ অংশের মানুষের তথা বাঙালিদের বশে রাখার জন্য তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাঙালিদের ঘাড়ে পাকিস্তানি সংস্কৃতি চাপিয়ে
দেওয়ার নীল নকশা তৈরি করে।
পাকিস্তানের কোনো অংশেই উর্দু ভাষা স্থানীয় ভাষা না হওয়া সত্ত্বেও ১৯৪৭ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাপত্রে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহারের সুপারিশসহ প্রচার মাধ্যম ও বিদ্যালয়ে কেবল উর্দু ভাষা ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়। যদিও তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা ও প্রতিবাদ জানানো হয় এবং নেতৃস্থানীয় বাঙালি প-িতগণ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার বিপক্ষে মত দেন এবং ঐ সমাবেশে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানে তথা বর্তমান বাংলাদেশে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রবল দাবি উত্থাপন করা হয়। কিন্তু পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বাংলাকে তাদের অনুমোদিত বিষয় তালিকা থেকে বাদ তো দিলই এবং সাথে সাথে মুদ্রা ও ডাক টিকিট থেকেও বাংলা অক্ষর বিলুপ্ত করে।
এরপর পাকিস্তান সরকারের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান মালিক উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর জন্য ব্যপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের বাঙালি ও ছাত্রদের মধ্যে ব্যপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়।
উক্ত সম্মেলনে ভাষা বিষয়ক কিছু প্রস্তাব গঠিত হয় । এ প্রস্তাবগুলো পাঠ করেন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান(বর্তমান বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান)। ভাষার প্রস্তাব উত্থাপন করে
ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান বলেন-“ পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে
তৎসম্পর্কে আলাপ আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত বলিয়া গণ্য হউক।” এভাবেই ভাষার দাবি প্রথমে উত্থাপিত হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুরু থেকেই ভাষার আন্দোলনে সরাসরি শরিক হন। ভাষা আন্দোলনের শুরুতে তমুদ্দুন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত কার্যক্রমে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রথম জীবনীকার অধ্যাপক ড. মযহারুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান এই মজলিসকে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বহুকাজে সাহায্য ও সমর্থন করেন(সূত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মযহারুল ইসলাম, পৃষ্ঠা:১০৪)। ১৯৪৭ সালের
ডিসেম্বরের শেষের দিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থনে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বাংলা ভাষার দাবির পক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে অংশগ্রহণ করেন; অংশগ্রহণ করেন মিটিং মিছিলে। ১৯৪৭ সালের ৫ ডিসেম্বর খাজা নাজিম উদ্দিনের বাসভবনে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক চলাকালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে অনুষ্ঠিত মিছিলে অংশগ্রহণ করেন এবং নেতৃত্ব দেন। ভাষার দাবিতে বারবার গ্রেপ্তার হন এবং কারাভোগ করেন।
১৯৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্রদের একটি বিশাল সমাবেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা মর্যদাদানের আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্ররা ঢাকায় মিছিল ও সমাবেশে আয়োজন করে। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি সদস্যদের বাংলায় বক্তৃতা প্রদান এবং সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত। ইংরেজিতে প্রদত্ত্ব বক্তৃতায় বাংলাকে অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে উল্লেখ করে ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যদা দেওয়ার দাবি তোলেন।
এছাড়াও সরকারি কাগজে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান তিনি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য প্রেমহরি বর্মন, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত এবং শ্রীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এ প্রস্তাবকে স্বগত জানালেও বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। গণপরিষদের এ ঘটনায় প্রথম প্রতিক্রিয়া শুরু হয় ঢাকায়। ২৬ শে জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ , জগন্নাথ কলেজ(বর্তমান
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) সহ অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে। ২৯ শে ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদ দিবস ও ধর্মঘট পালিত হয়। খাজা নাজিম উদ্দিন সরকারের প্ররোচনায় পুলিশ মিছিলে লাটি চার্জ করে এবং অনেক নেতা কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। এরপর ছাত্ররা ১১ মার্চ ধর্মঘট আহবান করে। পূর্ব পরিকল্পনা
অনুযায়ী ১১ মার্চ ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণাঙ্গ ধর্মঘট পালিত হয়। সকালে ছাত্রদের একটি দল রমনা ঘরে গেলে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। ছাত্রদের আরও একটি দল রাজনৈতিক নেতাদের সাথে মিশে গণপরিষদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, হাইকোর্ট ও সচিবালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে অফিস বর্জনের জন্য সবাইকে চাপ দিতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা খাদ্যমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ আফজল ও শিক্ষামন্ত্রী আব্দুল হামিদকে পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে।
এ সময় বিক্ষোভকারীদের উপর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ লাটিচার্জ করে। বিকেলে এর প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হলে পুলিশ সভা প- করে দেয় এবং কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর
রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী কাজী গোলাম মাহাবুব, রফিকুল আলম প্রমুখ।
মুহাম্দ আলী জিন্নাহ্র ঢাকা সফরঃ ১৯ শে মার্চ ১৯৪৮ সালে ঢাকায় এসে পৌঁছান পাকিস্তানের স্থাপতি ও গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ভারত বিভাগের পর এটাই ছিল তার প্রথম পূর্ব পাকিস্তান(বাংলাদেশ) সফর। ২১ শে মার্চ রেসকোর্স(বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে তার এক গণ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে তিনি তার ভাষণে ভাষা আন্দোলনকে পাকিস্তানের মুষলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ
করেন। যদিও তিনি বলেন, পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক ভাষা নির্ধারিত হবে প্রদেশের অধিবাসীদের ভাষা অনুযায়ী। কিন্তু দ্ব্যর্থহীন চিত্তে ঘোষণা করেন-“ উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়।” তিনি সতর্ক করে দিয়ে আরও বলেন, “জনগণের মধ্যে যারা ষড়যন্ত্রকারী রয়েছে, তারা পাকিস্তানের শত্রু এবং তাদের কখনোই ক্ষমা করা হবে না। মুহাম্মদ আলী জিন্নহ্ধসঢ়;র এ বিরূপ মন্তব্যে উপস্থিত ছাত্র জনতার একাংশ তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা” তাঁর এ ধরনের একপেশে উক্তিতে
বিক্ষোভকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এরপর ২৪ শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে গিয়েও তিনি উর্দুর ব্যাপারে তাঁর অবস্থানের কথা পুনরুল্লেখ করেন। তৎক্ষণাৎ উপস্থিত ছাত্ররা সমস্বরে না, না বলে চিৎকার করে ওঠে। এরপর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল জিন্নাহর সাথে সাক্ষাৎ করে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি পেশ করে। কিন্তু কোনো মন্তব্য না করেই ২৮ শে মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা ত্যাগ করেন এবং সেদিন সন্ধ্যায় রেডিওতে দেওয়া ভাষণে তাঁর পূর্বেকার অবস্থানের কথাই পুনর্ব্যক্ত করেন।
এরপর ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মারা গেলে খাজা নাজিম উদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৪৮ সালের ১৮ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে ছাত্র সভায় ভাষণ দেন। ঐ সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র ইনিয়নের তরফ থেকে প্রদত্ত্ব মানপত্রে বাংলা ভাষার দাবি পুনরায় উত্থাপন করা হয় কিন্তু কোনোরূপ মন্তব্য করা থেকে তিনি বিরত থাকেন। এরপর ১৯৫১ সালে ১৬ অক্টোবর লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে ১৯ আক্টোবর খাজা নাজিম উদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন।
১৯৫২ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকা আসেন তিনি এবং ২৬ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের এক জনসভায় দীর্ঘ ভাষণ দেন । কিন্তু ভাষণে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন মূলত জিন্নাহ্র কথারই পুনরুল্লেখ করে বলেন, “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচারিত তাঁর ভাষণে তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, কোনো জাতি দুটি ভাষা নিয়ে সমৃদ্ধির সাথে এগিয়ে যেতে পারেনি। নাজিমুদ্দিনের এ বক্তৃতার প্রতিবাদে বহুভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৯ শে জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। সেদিন ছাত্রসহ নেতৃবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল ৯ টা থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে এসে জড়ো হয়। বাংলার দামাল ছেলেরা বাঙালির বাকরুদ্ধ করার যে ষড়যন্ত্র তা আজ জীবন দিয়ে রুখবে। কোনো ভাবেই তারা মায়ের মুখের ভাষাকে কেড়ে নিতে দেবে না। তাই তারা ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে যেয়ে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”বলে স্লোগান দিতে থাকে। এ সময় পুলিশ সভাস্থলের চারিদিক ঘিরে রাখে। বেলা সোয়া ১১ টার দিকে ছাত্ররা গেটে জড়ো হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নেয়। তখন পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পুলিশের কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ না করতে অনুরোধ জানান এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগের নির্দেশ দেন। কিন্তু ছাত্ররা কাম্পাস ত্যাগ করার সময় কয়েকজনকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় ছাত্ররা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে পুনরায় তারা বিক্ষোভ শুরু করে। বেলা দুইটার সময় আইন পরিষদের সদস্যরা আইন সভায় যোগ দিতে এলে ছাত্ররা তাদের বাঁধা দেয় এবং সিদ্ধান্ত নেয় আইন সভায় গিয়ে তাদের দাবি পেশ করবে।এ উদ্দেশ্যে আইন সভার দিকে রওনা করলে বেলা
তিনটার সময় পুলিশ দৌঁড়ে এসে গুলিবর্ষণ শুরু করে। সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ভাষার দাবিতে দুর্নিবার বাংলা মাতার সাহসী বীর সন্তানেরা। বুলেটের আঘাতে রাজপথ রঞ্জিত করে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা অনেকে বাঙালির মুখের ভাষা তথা মাতৃভাষা রক্ষার্থে প্রাণের আহুতি দিলেন। পরদিন ২২ শে ফেব্রুয়ারি সারা দেশ হয়ে ওঠে মিছিল ও বিক্ষোভে উত্তাল। বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কর্মস্থল ত্যাগ করে ছাত্রদের মিছিলে যোগ দেয়। উত্তাল বাঙালি ও ছাত্রজনতার মিছিলে আবার পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় বাংলা মাতা তার আরও চার সন্তানকে হারান। একই দিনে নবাবপুর রোডের বিশাল জানাজার মিছিলে নৃশংস, পাষ-, বর্বর পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর পুলিশ বাহিনী গুলিবর্ষণ করে। শহীদ হন ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান সহ আরও অনেকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিল তখন জেল হাজতে। কারাগারের নির্যাতনের কঠিন সেলে বসে তিনি মাতৃভাষা রক্ষার্থে, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর থেকে বাংলার মানুষের মুক্তির চেতনায় নির্বাক ছিলেন। ভাষার দাবিতে বিদ্রোহী প্রতিবাদী বাংলার দামাল ছেলেদের খোজ খবর জানতে তাঁর মন ব্যাকুলতায় অস্থির ছিল। কারাগারের নির্দয় নিষ্ঠুর কঠিন সেলে বসে নিভৃতে চোখের পানি ফেলা আর মুক্তির পহর গণনা ছাড়া তারঁ যে কোনো পথ ছিল না।
সেদিন ছাত্র সমাজের প্রতিবাদী কন্ঠে ধ্বনিত হয় স্বাধিকারের দাবি।
বুকের তাজা রক্ত দিয়ে তারা লিখে যায় এক অনন্য ইতিহাস। তাদের নিসৃত রক্তে লেখা হয়ে যায় পূর্ব বাংলার অমোঘ ভাগ্যলিপি। তাদের এ মহান আত্মত্যাগের ফলেই বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর দেওয়া এক বিরল সম্মান বাঙালির যেমন শ্রেষ্ঠ অর্জন, তেমনি আমাদের মহান ভাষা শহীদদের আত্মদানের সুমহান স্বীকৃতি।
অসীম কুমার সরকার, সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, মোরেলগঞ্জ, বাগেরহাট।