গত ২৭ জানুয়ারি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ সেবিকা রুনু ভেরোনিকা প্রথম ভ্যাকসিন বা টিকা নিতে আসেন। সবার আগে ভ্যাকসিন নিতে আসা রুনুকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘তোমার ভয় লাগছে না তো?’ রুনুর জবাব ছিল- ‘না প্রধানমন্ত্রী।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘খুব সাহসী তুমি।’ এভাবেই শুরু হয়েছে আমাদের করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগের যাত্রা। বিশেষ গত দু-তিন সপ্তাহে জল কম ঘোলা হয়নি। আমরা খুব ভালো করেই জানি ‘প্যানডেমিক’-এর সময়ে ‘ইনফোডেমিক’ বিস্তৃত হয়েছে। অর্ধসত্য, আংশিক সত্য, বিকৃত তথ্য এখনকার তথ্যপ্রযুক্তির বাড়বাড়ন্তের সময়ে বেশি বেশি করে সংক্রমিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। আমরা কোনো কোনো ভ্রান্তিবিলাসে আক্রান্ত হয়ে যাই। সারা পৃথিবীতে ২১৮টি দেশ কভিড-১৯ অতিমারিতে আক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ৫৪তম দেশ হিসেবে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে পেরেছে। এটা যে আমাদের জন্য কত বড় সফলতা তা কি আমরা একবারও ভেবে দেখেছি। এটা যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কত বড় সৃজনশীল কূটনৈতিক দক্ষতা তা কি আমরা স্বীকার করি।
২. ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের তিন কোটি ও কোভ্যাক্সের (১৯০ দেশের সম্মিলিত উদ্যোগ) ছয় কোটি ৮০ লাখসহ মোট ৯ কোটি ৮০ লাখ করোনার ভ্যাকসিন পাওয়ার কথা বাংলাদেশের। ইতোমধ্যে অনেকটা আকস্মিকভাবেই বন্ধুত্বের শুভেচ্ছা হিসেবে ২০ লাখ ভ্যাকসিন বাংলাদেশে চলে এসেছে এবং প্রথম চালানের ৫০ লাখ ডোজ ইতোমধ্যে এসে গেছে। বাংলাদেশের পক্ষে সময়ের বেশ আগেই সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি করা গিয়েছিল। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির আবিস্কৃত ব্রিটিশ-সুইডিশ কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরির ভ্যাকসিন ভারতের মহারাষ্ট্রের পুনেতে সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত হয়েছে। এটাকে বলা হয়, ‘টোল ম্যানুফ্যাকচারিং’। এটা নিয়ে বিভ্রান্তির ছড়ানোর মতলব দেখতে পেয়েছি। কেননা আমরা ইংল্যান্ড থেকে আনলাম না ইত্যাদি ইত্যাদি। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন পেতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে সই করেছে বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মা। এই প্রতিষ্ঠান বছরে ১৩০ থেকে ১৫০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন তৈরি করতে সক্ষম। এই প্রতিষ্ঠান টিউবারক্লোসিস ভ্যাকসিন টিউবারভ্যাক (বিসিজি), পোলিওমাইইলিটিসের জন্য পোলিওভ্যাক উৎপাদনে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। এ ছাড়া ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু রোগ বিস্তারের সময় ভ্যাকসিন এবং ২০১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস মেডিকেল স্কুলের যৌথ গবেষণায় ফলে রেবিশিল্ড উদ্ভাবনে বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছিল। আমরা জানি, নানারকম ভ্যাকসিনের কল্যাণে সারাবিশ্বে মানুষের অকাল মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভবপর হয়েছে। এ কথা মানতেই হবে, করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা যত অগ্রগতি হয়েছে, আর কোনো ভ্যাকসিন নিয়ে এতটা হয়নি। আর আমাদের জনগণের জন্য টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চয়তার ব্যাপারে কোনো ধরনের সন্দেহের অবকাশ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে বিশ্বজুড়ে করোনার ৭৭টি ভ্যাকসিনের ১৯৪টি ট্রায়াল হয়েছে।
৩. করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন পাওয়া গেলেও তা নিতে অনীহা প্রকাশ করেছেন আমেরিকার ৩০ শতাংশ মানুষ! পিআর ফার্ম বোসপারের জরিপ বলছে, দেশটির এক-তৃতীয়াংশ প্রাপ্তবয়স্ক জানিয়েছিল, ভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিনের প্রতি তাদের আস্থা নেই। ভ্যাকসিন নেওয়া কিংবা না নিতে চাওয়াদের মধ্যে শিক্ষাগত যোগ্যতারও একটা পার্থক্য দেখা গেছে। মাস্টার্স পাস করা মানুষের ৮১ শতাংশ ভ্যাকসিন নিতে চান। পৃথক জরিপে দেখা গেছে, ব্রিটেন, রাশিয়া, জাপান ও ইন্দোনেশিয়ায় করোনার টিকা নেওয়া নিয়ে অনাগ্রহ দেখা দিয়েছে। অনেকে টিকা নিতে ভয় পাচ্ছেন। ব্রিটেনে জরিপে অংশ নেওয়া ১০০ জনের মধ্যে ছয়জন বলেছেন, টিকায় তাদের বিশ্বাস নেই। আর পাঁচজন জানিয়েছেন, তারা টিকার বিরোধী। করোনার টিকা নিয়ে জরিপ চালিয়েছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ)।
প্যারিসভিত্তিক মার্কেট রিসার্চ কোম্পানি আইপিএসওএসের সহযোগিতায় ১৫ দেশের সাড়ে ১৩ হাজার প্রাপ্তবয়স্কের ওপর অনলাইনে জরিপ চলে। এ জরিপে বলা হয়েছে, করোনার টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে ভীতির কারণেই আগ্রহ হারাচ্ছে মানুষ। সর্বশেষ এক জরিপের ফল বলছে, টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি করতে রাজি নন বেশিরভাগ ভারতীয়।
অক্টোবরে পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, তখন কভিড-১৯ টিকা গ্রহণ নিয়ে দ্বিধায় থাকা ভারতীয়র সংখ্যা ছিল ৬১ শতাংশ। পরে ফাইজার ও মডার্না তাদের উদ্ভাবিত টিকার ব্যাপক কার্যকারিতার ফল প্রকাশ করলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। নভেম্বরে টিকা গ্রহণ নিয়ে দ্বিধায় থাকা ভারতীয়র সংখ্যা ৫৯ শতাংশে নেমে আসে। সেরাম ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা তৈরির খবরে ভারতে নতুন আশার সঞ্চার করে। কিন্তু লোকাল-সার্কেলসের জরিপে দেখা যাচ্ছে, এ খবর টিকা নিয়ে ভারতীয়দের দ্বিধা আরও বাড়িয়েছে। এখন করোনার টিকা নেবেন কিনা তা নিয়ে দ্বিধায় ৬৯ শতাংশ ভারতীয়। টিকা নিয়ে এ অনীহার পেছনে বিভিন্ন কারণ সামনে আসছে। বড় দুটি কারণ হচ্ছে, টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও পরীক্ষামূলক প্রয়োগে এর কার্যকারিতার ফল নিয়ে সংশয়। জনসাধারণের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মীরাও এ দুটি কারণকে বড় করে দেখছেন। শুধু ভারতে নয়, অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রেও ভ্যাকসিন-ভ্রান্তির কথা অনেকেই জানেন। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের ২৬ তারিখে শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে তার ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন, ‘আশা করা হচ্ছে বিশ্ব শিগগিরই কভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন পাবে। এই ভ্যাকসিনকে বৈশ্বিক সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। সব দেশ যাতে সময়মতো এবং একই সঙ্গে পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। কারিগরি জ্ঞান ও মেধাস্বত্ব প্রদান করা হলে এই ভ্যাকসিন বিপুল পরিমাণে উৎপাদনের সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে।’
৪. ভ্যাকসিনের দাম নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টাও চলছে। বলা হচ্ছে, দুই ডলারের ভ্যাকসিন পাঁচ ডলার দিয়ে কেনা হচ্ছে। পুরোটাই মনগড়া ভিত্তিহীন নেতিবাচক গল্প ছাড়া আর কিছু নয়। গত বছর ৫ নভেম্বর বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট ও বেক্সিমকো ফার্মার সঙ্গে যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে, তা একটি অনন্যসাধারণ চুক্তি। চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়, ভারত সরকার সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে যে মূল্যে কিনবে, বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মা সেই মূল্যে ভ্যাকসিন পাবে। কিন্তু মূল্য কোনোভাবেই পাঁচ ডলারের বেশি হবে না। আবার মূল্য কমে গেলে তার সুবিধা বাংলাদেশ পাবে। চুক্তি অনুযায়ী ভ্যাকসিনের মূল্য সব মিলিয়ে চার ডলারের মতো পড়বে, কেননা ভারত সরকার ২.৭৭ ডলারের মতো মূল্য দিয়ে সেরাম থেকে কিনবে আর বেক্সিমকো ফার্মা এজেন্ট হিসেবে এক ডলার করে পাবে। তাহলে আমাদের জন্য প্রতি ভ্যাকসিনের মূল্য পড়বে ৩.৭৭ ডলার। এখানে দুই ডলারের ভ্যাকসিন পাঁচ ডলার মূল্যে বাংলাদেশ কিনছে। একটু স্মরণ রাখা দরকার, বাংলাদেশে ভ্যাকসিন এসেছে ভারতের পরপরই। বাংলাদেশ ৫৪তম দেশ হিসেবে ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু করেছে।
লেখক: সাবেক সহ সভাপতি, বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল; সম্পাদক – দৈনিক বাংলা সময়,
প্রধান সম্পাদক- সাপ্তাহিক বাংলা বিচিত্রা ও এবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম