খুলনা অঞ্চলে করোনা সংক্রমণ বাড়ার সাথে সাথে অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকটও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ফলে সময়মতো অক্সিজেন না পেয়ে অনেকে মারা যাচ্ছে বলে স্বজনরা অভিযোগ করছে। আর এ অবস্থায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্যেও অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে।
অক্সিজেন সিলিন্ডার কে আগে নেবে, তা নিয়ে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত রীতিমত কাড়াকাড়ি চলে রোগীদের স্বজনদের মধ্যে। এমনটাই দেখা গিয়েছে করোনার হটস্পট খুলনার কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে। সময়মতো অক্সিজেন না পেয়ে রোগী মৃত্যুর অভিযোগও বাড়ছে দিন দিন। অন্যদিকে বাসা বাড়িতে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের স্বজনরা তৎপর আগে ভাগে অক্সিজেন সিলিন্ডার বাগিয়ে নিতে। এতে নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে সেবা খাতে।
খুলনার সবচেয়ে বড় বিশেষায়িত হাসপাতালে ১৩০ শয্যার বিপরীতে গত কয়েকদিন যাবত রোগী ভর্তি থাকছেন ১৮০ থেকে ১৯০ জন। এখানে মাত্র ৭৭ টি শয্যায় রয়েছে কেন্দ্রিয় অক্সিজেনের সরবরাহ ব্যবস্থা, বাকি রোগীদের ভরসা সিলিন্ডার। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পাঁচ শ’ সিলিন্ডার মজুদের কথা বললেও হাহাকার থামছে না।
রোগীর এক স্বজন জানান, “অক্সিজেনের সিলিন্ডার আমি নিজে ঘুরিয়ে আমার রোগীর পাশে রাখি। একটু পর এসে দেখি সেটা আরেকজন নিয়ে গেছে। আমাদের মতো যারা নরমাল পেসেন্ট তারা সিলিন্ডার পাচ্ছে না।”
আরেক করোনা রোগীর ভাই জানান, “সিলিন্ডার না পেয়ে আমরা এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করতিছি। শুধু এই অক্সিজেনের জন্য আমার বোনটা মারা যাচ্ছে।”
করোনা প্রতিরোধ ও সমন্বয় কমিটির অন্যতম সদস্য ও মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা. মেহেদী নেওয়াজ গণমাধ্যমকে জানান, “রোগীর এমন চাপ অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি চলে যাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রোগীর সংখ্যা যখনই ১৭০ অতিক্রম করছে তখনই সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।”
অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের হিসেবে সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল, বিভিন্ন সংগঠন আর ব্যক্তি পর্যায়ে শুধুমাত্র করোনা রোগীদের জন্য খুলনা শহরে বর্তমান দৈনিক সিলিন্ডারের চাহিদা ৭০০ টি। তার বিপরীতে সরবরাহ করা যাচ্ছে মাত্র ৪১০ টি। তারা জানান, “ছোট সিলিন্ডারের চাহিদা প্রচন্ড বেড়ে গেছে, প্রতিনিয়তই রাতের বেলা ফোন আসে। অনেককে দিতে পারছি, অনেককে বলছি পরে আসেন, গাড়ি এখনো আসেনি বা আসতেছে। হঠাৎ করে চাহিদা যদি এক শ’ র জায়গায় দুই শ’ হয়ে যায় সেটা চ্যালেঞ্জিং।” ছোট সিলিন্ডারে এক হাজার ৩৬০ আর বড় সিলিন্ডারে অক্সিজেন ধারণ ক্ষমতা ছয় হাজার ৮০০ লিটার।
চাহিদা আর সরবরাহের ভিতর ফারাকের দূরত্ব ক্রমশই বাড়ছে। যে পরিস্থিতি চলছে তাতে অক্সিজেন সিলিন্ডার একসময় দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠতে পারে খুলনায়।
সাতক্ষীরা করোনা ডেডিকেটেড মেডিকেল কলেজ (সামেক) হাসপাতালের সেন্ট্রাল অক্সিজেন বিপর্যয়ের কারণে বুধবার (৩০ জুন) সন্ধ্যায় ৭ জন রোগী মারা যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠনও করেছে কর্তৃপক্ষ। তাদেরকে তিন দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
এদিকে খুলনা মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাবে করোনা পরীক্ষা গত ৩০ জুন হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। এখানকার মেশিন ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ায় কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত নেয়। তবে তার আগেরদিন অর্থাৎ ২৯ জুন মঙ্গলবার ২৬৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়। যা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৪৬.৭৪ শতাংশ। এর আগে সোমবার খুমেক ল্যাবে শনাক্তের হার ছিলো ৩৮.৯৩ শতাংশ, আর রবিবার ৩৯.৬৫ শতাংশ, শনিবার ৫০ শতাংশ, শুক্রবার ৩৭.৯০ শতাংশ, বৃহস্পতিবার ৫১.৫৫ শতাংশ, বুধবার ৩৪ শতাংশ আর মঙ্গলবার ৪০ শতাংশ। এই তথ্যই বলে দিচ্ছে খুলনা অঞ্চলে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি।
এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে মারা যাওয়া ১৪৩ জনের মধ্যে ৪৬ জনই খুলনা বিভাগের। সম্প্রতি সীমান্তবর্তী এ বিভাগ মৃতের তালিকায় শীর্ষেই থাকছে। এর মধ্যে খুলনা সাতক্ষীরা ও যশোরে প্রাণহানি বেশি হচ্ছে। নিহতদের মধ্যে করোনা পজিটিভ যেমন আছে, তার চেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে নানা উপসর্গে। ফলে অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকট দ্রুত নিরসন করতে না পারলে এখানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।