১৫ আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬তম শাহাদত বার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের এ দিনটি বাঙালি জাতির জীবনে একটি ঐতিহাসিক কালো অধ্যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি, বাঙালী জাতির আলোর দিশারী, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশীয় কতিপয় কুলাঙ্গার ঘাতকের নির্মম বুলেটে শাহাদত বরণ করেন। একই সাথে এ কুলাঙ্গাররা তার সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব যিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি পদক্ষেপে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন তাকেও নির্মম ভাবে হত্যা করে। পুত্র ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, দশ বছরের অবুঝ নিষ্পাপ শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, কৃষকনেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বেবী সেরনিয়াবাত, সুকান্ত বাবু, আরিফ, আব্দুল নঈম খান রিন্টুসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্যকেও এই দিনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমি শোকাহত ও মর্মাহত চিত্তে তাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এবং পরম করুণাময় মহান আল্লাহর দরবারে সকল শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
১৭ মার্চ ১৯২০, বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরনীয় দিন। এই দিনে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুন এর কোল আলো করে জন্মগ্রহন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পিতা-মাতার আদরের নাম ছিল ‘খোকা’। গ্রামের স্কুলেই হাতেখড়ি হয় শেখ মুজিবের। সেদিনের টুঙ্গিপাড়ার অজপাড়াগাঁয়ে জন্মগ্রহণ করা ‘খোকা’ নামের সেই শিশুটি পরবর্তী সময়ে হয়ে ওঠেন নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারি। কিশোর বয়সেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং তখন থেকেই এ দেশের মানুষের জন্য জেল ও কারাবরণ করা শুরু করেন। গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে শেখ মুজিব প্রথমবারের মতো গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় তাঁর আজীবন সংগ্রামী জীবনের অভিযাত্রা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশক শাসন অবসানের পর বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ‘৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ‘৫৮ এর সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ‘৬৬ এর ৬ দফা, ‘৬৯ এর গণঅভ্যূত্থান ও ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে সংগ্রামী সুদক্ষ নেতৃত্ব ও জয়ের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব হয়ে ওঠে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) একটি সভার আয়োজন করেছিল। লাখো জনতার এই সম্মেলনে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি এই আন্দোলন ও সংগ্রাম করতে যেয়ে তার যৌবনের ১৪টি বছর অর্থাৎ ৪,৬৮২ দিন কারাগারে কাটিয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধুর নাম চিরভাস্বর হয়ে আছে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৮ মিনিটের এক জাদুকরি ভাষণে বাঙ্গালী জাতিকে বিভোর করেছিলেন মুক্তির স্বপ্নে, আহবান জানিয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের। এরই ফলশ্রুতিতে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হয় আমাদের এই মহান স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় বঙ্গবন্ধুকে কারাবন্দি করে নির্যাতন ও হত্যার উদ্যোগও নেয় পাকিস্তানি শাসকরা। যদিও পরে আন্তর্জাতিক চাপের কারণে তা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে আসেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে এবং মনোনিবেশ করেন সোনার বাংলা গড়ার।
জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল বাঙ্গালী জাতিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রজ্ঞায়, শক্তি-সাহসে পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করার। এরই প্রয়াসে নিজের আরাম-আয়েশ, সুযোগ-সুবিধার কথা না ভেবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন দেশ ও জাতির কল্যানে। দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন অগ্রজ এবং নিপীড়িত মানুষের মুক্তির প্রথপ্রদর্শক। সোনার বাংলা বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল কৃষি ও শিল্পের বিপ্লব, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচনে সকল প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন। এরই ধারাবহিকতায় কৃষি ব্যবস্থায় গতিময়তা আনয়নের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা প্রদান করেন। তাঁর এই ঐতিহাসিক ঘোষনার ফলে দেশের সার্বিক কৃষি উৎপাদন সহ কৃষিশিক্ষা ও গবেষণায় ব্যাপক গতিশীলতা সঞ্চারিত হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল এ দেশীয় কুলাঙ্গাররা, পথভ্রষ্ট বিশ্বাসঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করে। এই দেশের অগ্রগতি-উন্নয়নসহ বাঙালী জাতীর ইতিহাসকে মুছে ফেলে পাকিস্তানী ভাবধারায় দেশকে বাঙালী জাতীয়তাবাদের উল্টো দিকে ঠেলে দেয়ার পায়তারা করেছিলো। কিন্তু যেকোন হত্যার মাধ্যমে মানুষকে দৈহিকভাবে বিদায় দেয়া যায়। কিন্তু তাঁর আজন্ম লালিত স্বপ্ন ও আদর্শকে বিদায় দেয়া যায় না। তৎকালীন ষড়যন্ত্রকারীরা ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্স জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথও বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এক মুজিব থেকে বাংলার ঘরে ঘরে জন্ম হয়েছে কোটি কোটি মুজিবের যারা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ায় অঙ্গীকার বদ্ধ। দীর্ঘ ২১ বছর পর পুনরায় ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু তনয়া সব ষড়যন্ত্র নিঃশেষ করে দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। পরবর্তীতে ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৯ এ দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিরলস পরিশ্রম করার মাধ্যমে দেশকে একটি উন্নত ও আধুনিক, উন্নত কৃষিনির্ভর, জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর দেখানো স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, উন্নয়নের রূপকার, মমতাময়ী মা জননেত্রী শেখ হাসিনা, বাংলদেশকে নিয়ে গেছেন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। দেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দেশ হিসেবে বিনির্মাণকল্পে দেশরতœ জননেত্রী উন্নয়নের ধারক ও বাহক শেখ হাসিনা উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় ২০২১ এ উন্নয়নশীল রাষ্ট্র, ২০৩০ এ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, ২০৪১ এর মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রে পরিবর্তনের অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে ডেল্টা প্লান ২১০০ প্রণয়ন করেন। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী করোনা অতিমারীর সময়েও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে ধরে রেখেছেন।
স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণ জয়ন্তীর ও জাতির পিতার জন্ম শতবাষির্কীতে দেশ, গণতন্ত্র ও সরকারবিরোধী সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের চলমান উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এই মাহেন্দ্রক্ষণে সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করার উদাত্ত আহবান জানাই।
শোককে শক্তিতে পরিণত করে আজকের এই দিনে আমরা যার যার অবস্থান থেকে নিজেকে নিয়োজিত রেখে জাতির জনকের আজীবন লালিত স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে দেশরতœ জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে আরও শক্তিশালী করবো । আল্লাহ্ আমাদের সহায় হোন। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ৪৬তম শাহাদত বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস-২০২১ অমর হোক।
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
প্রফেসর ড. মোঃ শহীদুর রহমান খান
ভাইস চ্যান্সেলর,
খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা।