এ এইচ নান্টু :: উপকূলীয় উপজেলা রামপাল ও মোংলার নদ-নদী বিভিন্ন কারণে মৎস্য শূন্য হয়ে পড়েছে। সরকারিভাবে তদারকির অভাব, অসচেতনতা ও অসাধু মৎস্য শিকারীদের কারণে এমনটি হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সুন্দরবনের নদী-খালে বিষ প্রয়োগ, নেট-পাটা, কারেন্ট জাল দিয়ে নির্বিচারে রেণু পোনা নিধন, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, কলকারখানা ও মোংলা বন্দরের জাহাজ থেকে ফেলা বিষাক্ত বর্জ্য এবং মাছের অভয়াশ্রম তীব্রভাবে সংকুচিত হয়ে পড়ার কারণে উপকূলীয় দুই উপজেলা রামপাল এবং মোংলার আন্তঃ নদী এবং খাল মৎস্য শূন্য হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে, সুন্দরবন দপ্তর ও মৎস্য দপ্তরের সমন্বয়হীনতার অভাবে মাছের এ ভরা মৌসুমেও নদী-খালের কোথাও মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। জানা গেছে, জোয়ার-ভাটা প্রবণ এ দুই উপজেলায় কয়েক হাজার হেক্টর নদী, খাল প্লাবনভূমি ও জলাভূমি রয়েছে। বর্তমানে এ উপজেলায় চাষকৃত ও সামুদ্রিক মাছ দিয়ে আমিষের চাহিদা পূরন হয়ে থাকে।
সিংগড়বুনিয়া গ্রামের বৃদ্ধ মুজিবর মোল্লা জানান, ৩০/৪০ বছর আগে আমাগে এই রামপাল গাংগে ও দাউতখালী (দাউদখালী) গাংগে ভরপুর মাছ ছেলো। এ্যান্যে গাংগে কোন মাছ নেই। সারাদিন জাল বাইয়েও কোন মাছ পাইনা। একই কথা বলেন, শ্রীফলতলা গ্রামের কালাম শেখ। তিনি জানান, এ্যাহন সারাদিন নদীতে জাল টাইনেও একশো টাহার মাছ পাতিচি না। সংসার চালানো বড় দ্বায় হয়ে পড়িচে। ৫/৬ জন মানষির সংসার। খাইয়ে না খাইয়ে দিন যাতিচে। ম্যালা মানষি মাছ ধরা ছাইড়ে দিয়ে অন্য কাজ করতিচে। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, কেন নদী ও খালে মাছ কমে গেল ? তারা জানান, নেট জাল দিয়ে মাছের ডিম ও পোনা মেরে নষ্ট করে ফেলার কারণে মাছ শেষ হয়ে গেছে। তারা আরও জানান, একটি বাগদা বা গলদার রেণু পোনা ধরতে গিয়ে শত শত মাছের ডিম ও রেণু পোনা মেরে ফেলছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র মোংলা আঞ্চলিক সমন্বয়কারী মো. নূর আলম এর কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, শিল্প বর্জ্য দুষন, প্লাস্টিক বর্জ্য দুষন, মোংলা বন্দরে তেলের জাহাজ, কয়লার জাহাজ ডুবি, সুন্দরবনে নির্বিচারে বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার, মাছের প্রজনন আধার সংকুচিত হওয়া, প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশ নষ্ট করে ফেলা, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে উচ্চ তাপমাত্রা বৃদ্ধি, নদ-নদীর নাব্যতা সংকটে মিষ্টি পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে পড়ার কারণে উপকূলীয় এ দুই উপজেলায় আগের মতো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। লবন ও মিষ্টি পানির সংমিশ্রণে এখানে অনেক প্রজাতির মাছ হতো যা এখন অনেকটা বিলুপ্তির পথে।
কথা হয় সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ লায়ন ডক্টর শেখ ফরিদুল ইসলাম এর সাথে। তিনি জানান, নদীতে নাব্যতা সংকট। স্রোত নেই, ইলিশ নেই। দেখার কেউ নেই। সুন্দরবনের ৫১ ভাগ বনভূমিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল করা হয়েছে। ওই সব বনে এক শ্রেণীর অসাধু জেলে নির্বিচারে বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার করছে। বন বিভাগের নজরদারি, তদারকির অভাবে মৎস্য নিধন ঠেকানো যাচ্ছে না। আর ওই বিষাক্ত পানির প্রবাহ উপকূলের নদ-নদীতে প্রবেশের কারণে মৎস্যের প্রজনন বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ও পরিবেশ না থাকার কারণে ইলিশসহ অনেক মাছ এখন পাওয়া যাচ্ছে না। জলবায়ু পরিবর্তন, নেট জাল ও কারেন্ট জাল দিয়ে রেনু পোনা নিধনে মৎস্যশূন্য হওয়ার বড় একটি কারণ। এ ছাড়াও নদীর উজান থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শুধু মাত্র বৃষ্টির পানি প্রবাহের উৎস নেই বললে চলে। যে কারণে আধা মিষ্টি, আধা লবন পানির সংমিশ্রণ না থাকায় অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে। সমুদ্র সীমায় ঢুকে ভারতীয় জেলেরা মৎস্য শিকার করছে এমন অভিযোগ ও শোনা যায়। পূর্বের মত হয়তো মৎস্য ভান্ডার খ্যাত এ সব উপজেলা বা উপকূলীয় এলাকায় মৎস্য পাওয়া যাবে না। আমিষের চাহিদা পূরনে তবে যা আছে সেটি সংরক্ষণ করা জরুরী। প্রয়োজনে আইন করে বা বিদ্যমান আইন বাস্তবায়নে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বিষ প্রয়োগ বন্ধ করতেই হবে। উপকূল রক্ষি বা কোস্ট গার্ড এবং বাংলাদেশ নেভীর আরও নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। বন বিভাগ ও মৎস্য বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে মাছের অভয়াশ্রম গুলি সুরক্ষিত করতে হবে, এ জন্য কোন আইন করা প্রয়োজন হলেও সেটি করতে হবে। কোন অবস্থাতে যেন নদী দুষণ না ঘটে এ জন্য নজরদারী রাখতে হবে। প্রয়োজনে মৎস্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ও সমন্বয় সাধন করে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে বন বিভাগকে কাজ করার উপর গুরুত্বারোপ করেন ডক্টর শেখ ফরিদুল।
এ ব্যপারে রামপাল উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা শেখ আসাদুল্লাহ জানান, বিভিন্ন কারণে আমাদের মৎস্য সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমিষের চাহিদা পূরনে মৎস্য চাষ বৃদ্ধির বিকল্প নেই । তিনি বলেন, নদী দুষণ বন্ধ, নাব্যতা বৃদ্ধি, প্লাবন ভূমির পানি প্রবাহ বৃদ্ধি, মৎস্যের অভয়াশ্রম বৃদ্ধিসহ সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতা মুক্ত করতে হবে। নদীর নব্যতা সৃষ্টি করতে পারলে পূর্বের মত ইলিশসহ সকল প্রকার মৎস্য বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়। এ সকল বিষয় বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানান।