যান্ত্রিক যুগ, কর্মচঞ্চল মানুষ। নিজকে নিয়েই তার যত ভাবনা, যত ব্যস্ততা। কর্মব্যস্ত জীবনে সময় কোথায় তার অন্যকে মনে করার, স্মরণ করার! একজন রাজনৈতিক কর্মি তার দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা কে বেমালুম ভুলে যাচ্ছে! যাদের রক্ত, শ্রম, ঘামে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ, একজন রাজনৈতিক নেতা তাকে ভুলে যাচ্ছে সময়ের পরিক্রমায়। দিন দিন আমরা আত্মকেন্দ্রিক জাতিতে পরিণত হচ্ছি। রাজনীতিতে দেশপ্রেম, মানবপ্রেম আর আত্মত্যাগের জায়গায় আত্মপ্রচার, স্বার্থপরতা ও ভোগবিলাস ঢুকে পড়েছে। উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির সকল সূচকে দেশ উর্ধ্বমুখী হলেও মানুষের মানবিক মূল্যবোধের অবনমন ঘটেছে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশেও আমরা বড় বেশি কৃপন হয়ে যাচ্ছি দিন দিন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ মনিরুল ইসলাম মনির কথা আমাদের ক’জনের মনে আছে? ক’জনই বা তাকে স্মরণ করি? সমাজের সাধারণ মানুষ কিংবা আজকের তরুণ প্রজন্মের কথা বাদই দিলাম। তারা হয়ত চেনে না, জানে না এই দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধা কে। কিন্তু আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে রাজনীতি করি, আমরা কি তাকে মনে রেখেছি? যে মানুষটি তার সমগ্র জীবনব্যাপী আমাদের স্বাধিকার, স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করেছেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছেন; মৃত্যুর এক যুগ পার না হতেই আমরা তাকে বেমালুম ভুলে গেছি!
১৯৪৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর ধর্মের ভিত্তিতে সদ্য প্রসূত পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব প্রদেশের অন্তর্গত খুলনা শহরের বয়রা ইউনিয়নের রায়েরমহল গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শেখ মনিরুল ইসলাম মনি। ৬০’র দশকের শুরুতে জড়িয়ে পড়েন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। নির্বাচিত হন বয়রা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি। বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনে ছাত্র ও যুবসমাজকে সম্পৃক্ত করতে কাজ করেন নিরলসভাবে। সাংগঠনিক দক্ষতার কারনে ৬০’র দশকের শেষভাগে বিএল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ৭০’র নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেনি। ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি শাসকের অব্যাহত টালবাহানার প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একদফার আন্দোলন শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। শেখ মনি এর অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই সাহসী ছাত্রনেতা। ২৬ শে মার্চ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা আওয়ামী লীগ সভাপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন শেখ মনিরুল ইসলাম মনি। মুজিব বাহিনী খুলনা জেলার সহ প্রধান প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ৯ নং সেক্টরের অধীন বৃহত্তর খুলনা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে রণাঙ্গনের যুদ্ধে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন অসীম সাহসী এই বীর।
শেখ মনিরুল ইসলাম মনির ছোট চাচা ছিলেন তৎকালীন প্রভাবশালী মুসলিম লীগ নেতা শেখ আব্দুল হামিদ। আব্দুল হামিদ তৎকালীন খুলনা জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
এমন একটি প্রভাবশালী মুসলিম লীগ পরিবারের সন্তান হয়েও মনি আমৃত্যু আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে ছিলেন ওতপ্রোতভাবে। জন্মস্থান রায়েরমহল ছিল স্বাধীনতা বিরোধীদের চারণভূমি। এই এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব এমনকি পরবর্তী কালেও মুসলিম লীগের শক্ত ঘাঁটি ছিল। এই এলাকায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়া ছিলো এক দুঃসাধ্য কাজ। যে কাজটি করতে গিয়ে তাকে এলাকা ছাড়তে হয়। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির নিপীড়ন, নির্যাতনে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। বারবার জীবন নাশের হুমকির মধ্যেও আদর্শের পথে ছিলেন অটল, অবিচল। বাড়ি ছেড়েছেন, গ্রাম ছেড়ে শহরে ভাড়া থেকেছেন কিন্তু আদর্শের সাথে আপোষ করেন নি।
রাজনীতির পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন অরাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শেখ মনিরুল ইসলাম মনি বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত “শহীদ স্মরণী” খুলনার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। “বঙ্গবন্ধু স্মৃতি চর্চা কেন্দ্র” খুলনার সাধারন সম্পাদক ছিলেন তিনি। বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন। খুলনার উন্নয়নে তিনি সোচ্চার ছিলেন। সামরিক স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে খুলনার রাজপথে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বৃহত্তর খুলনার আট দলীয় জোটকে সাহসিকতার সাথে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দীর্ঘদিন মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। খুলনায় আওয়ামী লীগকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে তার অবদান অপরিসীম। একজন তুখোড় বক্তা ছিলেন। মানুষ হিসেবে ছিলেন অমায়িক। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সাথে খুলনা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অনেক রাজনৈতিক কর্মসূচীতে তার সরব উপস্থিতি ছিলো। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর পাইকগাছা সফরে বঙ্গবন্ধুর সাথে মঞ্চের সামনের সারিতে তার অবস্থান তৎকালীন রাজনীতিতে তার গুরুত্ব ও প্রভাব সম্পর্কে বোঝার জন্য যথেষ্ট।
বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য মনি ২০১১ সালের ১৮ ই মার্চ এই ধরাধাম থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। তার রক্তের উত্তরসূরী দুই পুত্র সন্তান এস এম শাহরিয়ার সুমন এবং এস কে শাহনেওয়াজ সুজন সরাসরি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নন। তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে মনেপ্রাণে ধারণ করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ মনি আমৃত্যু বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন, সংগ্রাম করেছেন। মৃত্যুর পূর্বে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় কার্যকর হতে দেখে গেছেন। এটাই ছিল তার জন্য সবচেয়ে স্বস্তির এবং আনন্দের। প্রায় অর্ধ শতকের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কেবলমাত্র রাজনৈতিক কারনে মামলার আসামি হয়েছেন, এই দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য হাসিমুখে কারাজীবন বেছে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ কর্মি, খুলনা আওয়ামী লীগের দুর্দিনের নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক শেখ মনিরুল ইসলাম মনির আজ ৮০ তম জন্মদিন। জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা প্রয়াত এই বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতি। বর্তমান প্রজন্মের একজন হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকলের প্রতি আমার আহবান আমরা যেন জাতির এমন শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ভুলে না যায়। তাদের দেশপ্রেম, সাহস ও আত্মত্যাগের মনোভাব হোক আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানে আমাদের অন্যতম পাথেয়।
লেখকঃ মোঃ নজরুল ইসলাম, কলামিস্ট এবং তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, ১৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, খুলনা মহানগর।