ক্রীড়া ডেস্কঃততদিনে ভারতে পুরুষদের ক্রিকেট বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও ততটা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি মেয়েদের ক্রিকেট। সালটা ১৯৯৯। সে সময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবির্ভাব ঘটল পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির এক ভারতীয় নারী ক্রিকেটারের। অভিষেকের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। এরপর একে একে কেটে গেলে ২০টি বছর। বছর গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ডের বহু শৃঙ্গ জয় করেছেন তিনি। বলছিলাম ভারতীয় নারী ক্রিকেটের ‘রানী’ মিতালি রাজের কথা।
অনেকেই তাকে ‘লেডি শচীন’ বলে ডাকেন। তবে তিনি শচীন নন, তিনি মিতালি রাজ। নিজের জগতে একে বারে স্বতন্ত্র। বাবা দরাই রাজ ছিলেন বায়ুসেনা। তাই ছোট থেকেই ছিল লড়াকু মনোভাব। জানতেন, যুদ্ধে মাথা ঠান্ডা রাখাই সবচেয়ে বেশি দরকার।
‘লেডি শচীন’ খ্যাত মিতালির জন্ম ১৯৮২ সালে হায়দরাবাদের ত্রিমুলঘেরিতে। তার স্কুল জীবন শুরু হয় সেকেনদরাবাদের কিইস হাই স্কুল থেকে। আর এখানে থাকতেই শুরু হয় ক্রিকেটের পাঠ। তারপর ভর্তি হন কস্তুরবা গাঁধী জুনিয়র কলেজে। কিন্তু মাত্র ১৬ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়ে যাওয়ার ইন্টার মিডিয়েটের বেশি পড়তে পারেননি মিতালি রাজ।
লক্ষ করা যেতে, বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে ব্যাট করতে নামার আগে বই পড়ছেন মিতালি। আসলে বরাবরই শান্ত তিনি। মাঠে নেমে বোলারদের ঘুম উড়িয়ে দিলেও নিজে থাকেন নির্লিপ্ত। অথচ ক্রিকেটার নয় ছোটবেলায় মিতালি স্বপ্ন দেখতেন নৃত্যশিল্পী হওয়ার।
ক্রিকেট শেখার আগে ভরতনাট্যম শিখতেন তিনি। তাই তো নাচ দিয়েই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু বড় অলস ছিলেন মিতালি রাজ, নিজেই একবার জানিয়েছিলেন সে কথা। সেনায় যুক্ত থাকা কর্মঠ বাবার পছন্দ ছিল না আলস্য। মেয়েকে জব্দ করতে ভর্তি করে দেন ক্রিকেট কোচিং স্কুলে।
নৃত্যশিল্পীর স্বপ্ন বোনা মিতালি মা-বাবা-কে খুশি করতে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন। এরপর নিজেই ধীরে ধীরে ভালোবেসে ফেলেন ক্রিকেটকে। যদিও তার ইচ্ছে ছিল সিভিল সার্ভিসে যোগ দেয়ার। তা হলে হয়তো টিম ইন্ডিয়া হারিয়ে ফেলত এক অনন্য ক্রিকেটারকে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অভিষেকের ম্যাচেই সেঞ্চুরির দেখা পান মিতালি। ১১৪ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে। সে ম্যাচের স্কোরের হিসাবে যা তৃতীয় সর্বোচ্চ। ভারতীয় নারী ক্রিকেটারদের মধ্যে তিনিই প্রথম ব্যাটসম্যান যিনি অভিষেক ম্যাচে সেঞ্চুরি করেন।
মাত্র ১৬ বছর ২৫০ দিন বয়সে অভিষেক ঘটে তার। আর সেই ম্যাচে শতরানের মাধ্যমে তিনি হয়ে যান কনিষ্ঠতম সেঞ্চুরি প্রাপক। রেকর্ড গড়ে ক্রিকেট জীবন শুরু করেছিলেন, সেই রেকর্ড ভাঙাই যেন অভ্যাস করে ফেলেছিলেন ক্রিকেট জীবনে।
অভিষেক ম্যাচে টিম ইন্ডিয়ার নারীদের মধ্যে সব চেয়ে বড় পার্টনারশিপ গড়া (রেশমা গাঁধীর সঙ্গে ২৫৮ রানের), এক দিনের ক্রিকেটে সব থেকে বেশি রান (৬৭২০) এমন বহু রেকর্ড রয়েছে মিতালির ঝুলিতে।
অভিষেকের পাঁচ বছর পর ভারতীয় নারী দলের কাপ্তান হন মিতালি। দেশের হয়ে ৯০টি এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের নেতৃত্ব দেন তিনি। যার মধ্যে টানা ৫৭টি ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন মিতালি।এই তালিকায় এক নম্বরে রয়েছেন বেলিন্ডা ক্লার্ক। তিনি টানা ৫৮টি ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক ছিলেন। ভারতের নারী দলের কনিষ্ঠতম অধিনায়কও মিতালিই। মাত্র ২১ বছর বয়সে নেতৃত্বর দায়িত্ব তুলে দেয়া হয় তার কাঁধে।
মিতালির নেতৃত্বেই ভারতীয় নারী দল প্রথম টেস্ট সিরিজ যেতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালে। এর আগে ২০০৫ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকায় তার নেতৃত্বে ফাইনালে ওঠে ভারত। যদিও শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার কাছে হার মানতে হয় টিম ইন্ডিয়াকে।
মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটকে বিদায় জানান মিতালি। তবে একদিনের ম্যাচ খেলবেন বলেই জানিয়েছেন এই ব্যাটসম্যান। ২০২১ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপকে পাখির চোখ করছেন মিতালি। ভারতের জার্সি গায়ে এখন পর্যন্ত ২০৩টি একদিনের ম্যাচে ৬৭২০ রান করেছেন তিনি, রয়েছে সাতটি সেঞ্চুরি। ১০টি টেস্ট ম্যাচে করেছেন ৬৬৩ রান, সেখানেও রয়েছে একটি সেঞ্চুরি।
তার ২০ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে অনেক ঝড়-ঝাপটা সামলেছেন। ২০১৮ সালের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে বাদ পড়তে হয় প্রথম একাদশ থেকেও। বয়স থাবা বসিয়েছে ফর্মে। রান মেশিন মিতালি এক দিনের ক্রিকেটে শেষ শতরান করেছেন এক বছর আগে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে। যদিও গড় এখনো পঞ্চাশের ওপরে।
মিতালি রাজ ২০০৩ সালে ভারতের অর্জুন পুরস্কার, ২০১৫ সালে পদ্মশ্রী পান। ২০১৫ সালে প্রথম নারী ক্রিকেটার হিসেবে পান উইজডেন ইন্ডিয়া ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার সম্মান। আইসিসির সবশেষ ঘোষণা অনুযায়ী এক দিনের ক্রিকেটে তার র্যাঙ্কিং পাঁচ।