নিয়মনীতির কোনো কিছু না মেনেই খুলনা মহানগর ও আশপাশ এলাকায় গড়ে উঠেছে পরিত্যক্ত ব্যাটারি মেরামত ও রিসাইকেল কারখানা। যার কারণে বাড়ছে সিসা দূষণ। ফলে মাটি, পানি ও নিঃশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করছে সিসা। খুলনার শিশুদের রক্তেও পাওয়া গেছে অতিমাত্রায় ভয়ংকর সিসার উপস্থিতি। এর প্রভাবে শুধু শিশুদের নয়; বয়স্ক ও গর্ভবতী নারীদেরও বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। সম্প্রতি ইউনিসেফ এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর এর সমীক্ষায় মিলেছে এমন উদ্বেগজনক তথ্য। বড়দের তুলনায় শিশুদের শরীরে সিসার প্রভাব বেশি হওয়ায় এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। নতুবা পুরো একটা প্রজন্ম বুদ্ধিহীন হয়ে যাবে মনে করেন শিশু বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, খুলনা দৌলতপুর থানার তিন নং ওয়ার্ড ও বটিয়াঘাটা উপজেলার মোহাম্মদনগর এলাকায় ২৪৭ শিশুকে এই গবেষণার আওতায় আনা হয়। যাদের সবার শরীরেই সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এসব শিশুর রক্তে ৩ দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রাম পার ডেসিলিটারের বেশি সিসা পাওয়া গেছে; যা অত্যন্ত ভয়াবহ। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশের রক্তে সিসার পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি। বিভিন্ন অপরিকল্পিত শিল্প ও ব্যাটারি রিসাইকেলিং কারখানার কারণে এ অঞ্চলে সিসাদূষণ বাড়ছে। এছাড়া রঙ, খেলনা, তৈজসপত্র, প্রসাধনী, মসলাসহ, পানি ও নিঃশ্বাসের মাধ্যমে এ পদার্থ মানবদেহে প্রবেশ করছে। এর প্রভাবে কিডনি, মাংসপেশি, স্নায়ুতন্ত্র জটিলতা, বুদ্ধিমত্তা হ্রাস, আচরণগত ও স্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যাসহ শৈশবকালীন, ভবিষ্যৎ ও সামাজিক নেতিবাচক প্রভাবের শঙ্কা রয়েছে।
বটিয়াঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. মিজানুর রহমান বলেন, খুলনাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় অনেক আগে থেকেই ব্যাটারি মেরামত ও রিসাইকেল কারখানা রয়েছে। এখন কারখানার সংখ্যা কমলেও এ এলাকায় পরিবেশে সিসার উপস্থিতি রয়েছে। সম্প্রতি খুলনা শহরের দৌলতপুর ও বটিয়াঘাটা উপজেলার মোহাম্মদনগর এলাকার ২৪৭ শিশুর রক্তে সিসার উপস্থিতি মিলেছে। বয়স্কদের চেয়ে শিশুদের শরীরে সিসার নেতিবাচক প্রভাব বেশি পড়ে। গর্ভবতী মায়েরাও সিসাদূষণের শিকার হন। এতে বিকলাঙ্গ শিশুরও জন্ম হতে পারে।
খুলনা শিশু হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা: মো: কামরুজ্জামান বলেন, সিসার প্রভাবে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা কমে যায়। ছোটবেলা থেকেই যাদের শরীরে সিসার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি মিলছে, বড় হয়ে তাদের আগ্রাসী হয়ে ওঠার আশঙ্কাও অনেক বেশি।
খুলনার সিভিল সার্জন ডা. সবিজুর রহমান বলেন, ‘সিসা একটি মারাত্মক ক্ষতিকারক পদার্থ; যা বাতাসের সঙ্গে মিশে মানবদেহে প্রবেশ করে। শিশুরাই সিসার দ্বারা বেশি ক্ষতির শিকার হয়। খুলনায় সিসার মাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি। মিল কলকারখানার ধোঁয়ার সঙ্গেও বাতাসে সিসা মিশতে পারে। ব্যাটারি তৈরিতে সিসার ব্যবহার হয়। আবার ব্যাটারি জ্বাল দিয়ে সিসা বের করা হয়। এসব কারণে সিসা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। এর প্রভাবে পেট ব্যথা, মাথাব্যথা হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘সিসা বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সিদের ক্ষেত্রে ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। মস্তিষ্কের পুরোপুরিভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাওয়ার আগেই ক্ষতিসাধন করে। এরপরে শিশুদের সারা জীবনের জন্য মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মুখে ফেলতে পারে। মারাত্মক সিসাদূষণ অনেক সময় মৃত্যুর কারণও হতে পারে। বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত সিসায় দূষিত হচ্ছে রাস্তার পাশের এবং রেস্টুরেন্টের সব খাবার, খোলা বাজারের চাল, ডাল, মশলা, কাঁচা সবজি, মাছ, মাংস, আঁশ ছাড়া মাছ, গুঁড়ো মশলা, বিস্কুট সবটাই। ধুলা, মাটি, পানি, জলাশয়ে ব্যাটারি শিল্পের সিসা মিশছে। শুধু বাইরের খাবার নয়, ঘরের খাবারেও সিসা ঢুকে যাচ্ছে বিভিন্নভাবে। শিশুরা যেসব প্লাস্টিক খেলনা নিয়ে খেলা করে তাতে যে রঙ ব্যবহার হয় সেখানেও সিসা মিশে আছে। তিনি বলেন, এই গবেষণায় বলা হয়েছে, খুলনা জেলায় সিসা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।’
খুলনা বিভাগীয় পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক মো. ইকবাল হোসেন বলেন, অবৈধ শিল্প ও ব্যাটারি রিসাইকেল প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। এর আগেও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করা হয়েছে। যারা নিয়ম মানছেন না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, ব্যাটারি প্রস্ততকারক প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে কয়েক দফায় আলোচনা করা হয়েছে। তারা আইন মেনে তাদের কার্যক্রম করবেন আমাদের আশ্বস্ত করেছেন।