বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক করা হয়েছে এক পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতাকে। এমনকি চাকরি করছেন বরিশাল সিটি করপোরেশনে। যার ছাত্রত্ব ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। শুধু তাই নয়, কমিটি ভেঙ্গে দেওয়ার ১৪ মাস পর বিতর্কিত ও বুড়োদের নিয়ে ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
এসব কারণে কমিটি অনুমোদনের পর থেকে বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা ও তুমুল বিতর্ক।
মো. রইজ আহমেদ মান্নাকে আহ্বায়ক, মো. মইনুল ইসলাম এবং আরিফুর রহমান শাকিলকে যুগ্ন আহ্বায়ক করে ৩২ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটি ২৩ জুলাই (শনিবার) অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কমিটি অনুমোদনের কথা জানানো হয়।
২০১১ সালে জসিম উদ্দিনকে সভাপতি, অসীম দেওয়ানকে সাধারণ সম্পাদক এবং তৌছিক আহম্মেদ রাহাতকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে আংশিক কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। সেই কমিটি গঠনের ১০ বছর পর ২০২১ সালের ২৫ মে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি জসীম উদ্দিনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে।
এরপর বরিশাল মহানগরে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি ছিল না। ২০১১ সালে আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ২০২১ সালে এই কমিটি বিলুপ্তির এক বছর পর গতকাল বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন দেয়।
নতুন কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয় মো. রইজ আহমেদ মান্নাকে। অভিযোগ উঠেছে, রইজ আহমেদ বরিশাল জেলা বাস মালিক গ্রুপের কার্যনির্বাহী সদস্য। চলতি মাসে গঠিত বরিশাল বিভাগীয় আঞ্চলিক সড়ক পরিবহন মালিক ফেডারেশনের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও বরিশাল বিভাগীয় আঞ্চলিক সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিক ঐক্য ফেডারেশনের আইন বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। তার ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে চলতি বছর।
জানা গেছে, রইজ আহমেদ মান্না সরকারি ব্রজমোহন কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বরিশাল শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত আইন কলেজ থেকে চলতি বছর (২০২২) সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে এলএলবি সম্পন্ন করেছেন।
মান্না বর্তমানে বরিশাল সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী (মাস্টার রোলে) কর্মচারী হিসেবে কর্মরত। এসএসসি পরীক্ষার সনদ অনুযায়ী মান্নার বয়স ৩২ বছর। তালিকার এক নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক মো. মাইনুল ইসলাম এক বছর আগে বিয়ে করেছেন। এসএসসির সনদ অনুযায়ী তার বর্তমান বয়স ৩০ বছর।
আর দুই নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুর রহমান শাকিল বিয়ে করেছেন চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি। তার বয়সও ত্রিশের কাছাকাছি।
অথচ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ৫-এর-গ-এ বলা আছে, কোনো নিয়মিত শিক্ষার্থী (৫-এর-ক উপধারা অনুযায়ী) ছাত্রলীগের কর্মকর্তা ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য হতে পারে। বিবাহিত, ব্যবসায়ী ও চাকরিতে নিয়োজিত ছাত্র-ছাত্রী ছাত্রলীগের কর্মকর্তা হতে পারবে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের এক নেতা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘রইজ আহমেদ মান্না দুই সন্তানের বাবা। তা ছাড়া তিনি শ্রমিকলীগের নেতা। তিনি কিভাবে ছাত্রলীগ করে?’
তিনি আরও বলেন, ‘নতুন কমিটিতে যে দুই জনকে যুগ্ন আহ্বায়ক করা হয়েছে তাদের একজনের বয়স ৩৯ থেকে ৪০ বছর। ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে অনেক আগে। তাহলে এই কমিটি কিভাবে হয়? সেই প্রশ্ন থেকে গেল।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের একাধিক নেতা বলেন, যাদের কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে তারা সকলেই বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠজন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে তিনি যা সুপারিশ করেছেন সেই অনুযায়ী আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে কোনো যাচাই-বাছাই হয়নি। গঠনতন্ত্রের ৫-এর গ ধারা লঙ্ঘন করে আহ্বায়ক কমিটিতে বিবাহিত ও সিটি করপোরেশনে কর্মরতদের স্থান দেওয়া হয়েছে।
বরিশালের রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই কমিটি যথাযথ নিয়মে করা হয়নি। এটি ছাত্রলীগের ইতিহাস ও গঠনতন্ত্র বহির্ভূত। কারণ কোনো বিবাহিত পুরুষ ছাত্রলীগে অবস্থান করতে পারে না। সেখানে দায়িত্ব দূরের কথা। তাছাড়া এই কমিটিতে যে দুই জনকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে তারা অছাত্র এবং বিবাহিত। তাদের মধ্যে কেউই নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য নয় বলে মনে করছেন স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্তরা।
বরিশাল মহানগর কমিটির বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের সঙ্গে মোবাইলে একাধিক বার যোগাযোগ করেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকি এসএমএস দিলেও জবাব পাওয়া যায়নি।
বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটির বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি মো. আরিফ মুঠফোনে ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, তিনি বরিশালের কমিটি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চান না।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক নিক্সন সজিব ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘এই মুহূর্তে এই কমিটি নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। বরিশালে যারা সাংগঠনিক দায়িত্বে আছেন তাদের কাছে প্রশ্ন করলে খুশি হব।’
অবশ্য বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের নবগঠিত কমিটির সদস্যদের দাবি, দীর্ঘ সময় ধরে বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি হচ্ছিল না। এতে নেতৃত্ব সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া আমরা যারা ছাত্রলীগ করে আসছি তাদের কর্মী ছাড়া আর কোনো পরিচয় ছিল না। এই কমিটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে কিছু নেতাকর্মী অন্তত পরিচয় বহন করতে পারবেন।
কমিটিতে স্থান পাওয়া অন্য ২৯ সদস্যের মধ্যে রয়েছেন, ফয়সাল বাড়ি নয়ন, কিসমত শাহরিয়ার হাসান, হাসিবুর রহমান রাজন, মাহবুব হাসান অমিত, ইয়াসির আরাফাত, মো. সাইফুল ইসলাম পারভেজ, রাশেদুল ইসলাম, আকাশ সিকদার, মো. রোমান, মো. সিরাজুল ইসলাম, আরিফুর রহমান, আহমেদ রেদওয়ান, সাজ্জাদ আহমেদ, মিরাজুল ইসলাম, মো. আল আমিন, শাওন রাকিব, জামশেদ আল ফাহত, শেখ তৌহিদুল ইসলাম, সাগর দেবনাথ, রিয়াজ মল্লিক, তৌহিদুল ইসলাম শাওন, জয় মালি, রাফিজুল শান, হান্নান মল্লিক, পারভেজ সিকদার, মোহাম্মদ ইমন রহমান, ফয়সাল বিন জাবেদ এবং মাহফুজুর রহমান।
উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, আগামী তিন মাসের জন্য বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বরিশাল মহানগর শাখার আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন দেওয়া হলো।