ইমদাদুল হক:: জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষির ঝুঁকি এবং সংকট যেমন বাড়ছে, তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাড়ছে নতুন নতুন উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার। সংকটের পাশাপাশি সম্ভাবনাও তৈরী হচ্ছে। সিডলিং ট্রেতে চারা উৎপাদন করে নতুন এক সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছেন উপকূলীয় খুলনার পাইকগাছা উপজেলার স্মার্ট কৃষক মলয় মন্ডল। দুই বছরের ব্যবধানে এলাকায় সম্ভাবনাময় কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে ইতোমধ্যে পরিচিতি লাভ করেছে উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন গড়ইখালী ইউনিয়নের হোগলারচক গ্রামের কালিপদ মন্ডলের ছেলে মলয় মন্ডল। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ শেষে চাকুরির প্রতি আগ্রহ না দেখিয়ে কৃষি কাজে মনোনিবেশ করেন শিক্ষিত যুবক মলয়। বর্তমানে মলয় প্রতিবছর সিডলিং ট্রেতে ১২ লাখ টাকার চারা উৎপাদন করছেন। নিজের কৃষি কাজে ব্যবহার করার পাশাপাশি প্রতিবছর ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার চারা বিক্রি করছেন মলয়। মলয়কে দেখে এলাকার অনেকেই এ পদ্ধতির চারা তৈরীতে এগিয়ে এসেছেন।
উল্লেখ্য, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এদিকে দেশের মধ্যে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে উপকূলীয় অঞ্চল। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এ অঞ্চলের বেশিরভাগ নদ-নদী ভরাট হয়ে কৃষির জন্য চরম এক সংকট তৈরী করেছে। পাশাপাশি লবণাক্ততা বৃদ্ধি সহ ঘন ঘন প্রাকৃতির দুর্যোগে হ্রাস পেয়েছে কৃষি উৎপাদন। নানা সংকট আর চ্যালেঞ্জ নিয়ে কৃষি কাজ করছেন উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকরা। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার সহ কৃষি বিভাগও নানান কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করছেন। গবেষণা ইনস্টিটিউটগুলো উদ্ভাবন করছেন নতুন নতুন ফসলের উন্নত জাত ও প্রযুক্তি। কৃষকরাও এসব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে কৃষিতে সম্ভাবনা সৃষ্টি করছেন।
কৃষক মলয় মন্ডল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সার্বিক সহযোগিতা নিয়ে ২০২২ সাল থেকে সিডলিং ট্রেতে চারা উৎপাদন শুরু করে। চারা উৎপাদনের কাজে তিনি জৈব সার এবং কোকোপিট ব্যবহার করছেন। এ পদ্ধতিতে মলয় তরমুজ, মরিজ, বেগুন, পেপে, টমেটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, করল্লা ও রক মেলন সহ বিভিন্ন সবজির চারা উৎপাদন করছেন। এ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করলে উৎপাদন খরচ কম হয় এবং সুস্থ্য সবল রোগমুক্ত চারা পাওয়া যায়। ট্রেতে বিভিন্ন প্রজাতির চারার জীবনকাল যেমন, তরমুজ ১২-১৫ দিন, মরিচ ২৫-৩০ দিন, বেগুন ৩০-৩৫ দিন, টমোটো ২০-২৫ দিন, পেপে ৪০-৪৫ দিন ও করল্লা ২০-২৫ দিন।
কৃষক মলয় মন্ডল বলেন, আমি বসতবাড়ীর সাথেই সিডলিং ট্রেতে চারা উৎপাদন করে থাকি। আমার এখানে সারা বছর চারা উৎপাদন করা হয়। প্রতিবছর ১২ লাখ টাকার চারা উৎপাদন করা হয়। যার মধ্যে নিজের চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় চারা ব্যবহার করি এবং অন্যান্য চারা কুরিয়ার ও পরিবহনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রয় করে থাকি। এ বছর আমি নিজেই ৫৫ বিঘা জমিতে তরমুজ, ৩ বিঘা জমিতে মরিচ, ২ বিঘা জমিতে বেগুন এবং ১ বিঘা জমিতে রক মেলন চাষ করেছি। বিপুল পরিমাণ এ চারা আমি ট্রেতে উৎপাদিত চারা ব্যবহার করেছি। এতে চারা উৎপাদন খরচ অনেক কম হয়, শ্রমও কম লাগে। উৎপাদিত চারা থেকে বছরে উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা লাভ হয়। আমি ৩শ কৃষককে নিয়ে একটি হোয়ার্টস অ্যাপ খুলেছি। হোয়ার্টস এবং সরাসরি এলাকার কৃষকদের কৃষি সংক্রান্ত পরামর্শ দিয়ে থাকি।
মলয়কে অনুসরণ করে এলাকার অনেকেই সিডলিং ট্রেতে চারা উৎপাদন করছে উল্লেখ করে উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ অসীম কুমার দাস বলেন, এ পদ্ধতিতে চারার স্বাস্থ্য ভালো থাকে, রোগ পোকার আক্রমণ কম হয়। প্রতিটি চারা সমান পুষ্টি উপাদান পায়। শেকড় না ছেড়ার ফলে মাঠে সহজে প্রতিষ্ঠিত হয় চারার মৃত্যু হার অনেক কম। অতিরিক্ত বীজ লাগেনা, মূল ফসল উৎপাদন ব্যয় কম হয়। বাড়তি পরিচর্যা এবং শ্রম কম লাগে। ট্রাইকোডার্মা পাউডার (উপকারী ছত্রাক) পানিতে গুলে চারার গোড়া চুবিয়ে নিলে রোগ জীবানু মুক্ত হয় এবং পচন হয় না। ট্রেতে চারা উৎপাদন সহজ এবং লাভজনক হওয়ায় মলয়কে অনুসরণ করে এলাকার অনেক কৃষক নিজেদের প্রয়োজনীয় চারা তারা ট্রেতে উৎপাদন করছে। এটি উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষির জন্য অনেক ভালো একটি সম্ভাবনা বলে উল্লেখ করেন কৃষি বিভাগের এ কর্মকর্তা।