করোনা মহামারীর কারণে কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে আসছেন প্রবাসী কর্মীরা। কিন্তু দেশে এসেও নিরুপায় তারা। কারণ উপার্জন নেই। করোনার প্রথম ঢেউ শুরুর সময় যারা এসেছেন তাদের গচ্ছিত অর্থও শেষ।
অনেকে আবার কোনো অর্থকড়ি নিয়ে আসতে পারেননি। তাই বাধ্য হয়ে তারা আবার ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বাধা সেই করোনা। কেউ কেউ ফিরে গেলও অনেকের যাওয়া অনিশ্চিত।
ইতোমধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। অর্থাৎ কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখি তারা। কী করে বাঁচবেন সে পথও খুঁজে পাচ্ছেন না। বিষয়টি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকেও ভাবিয়ে তুলেছে।
তারা ফেরত আসা প্রবাসী শ্রমিকদের আপাতত যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী দেশেই কর্মসংস্থানসহ পুনর্বাসনের সুপারিশ করেছে। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদ ভবনে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়।
কমিটির সভাপতি মুজিবুল হকের সভাপতিত্বে বৈঠকে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, শাজাহান খান, শামসুন নাহার এবং মো. আনোয়ার হোসেন (হেলাল) উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে দেশে ফেরা প্রবাসী শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। কমিটির একাধিক সদস্য তাদেরকে আর্থিক প্রণোদনা দেয়াসহ বিকল্প উপায়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য তাগিদ দেন।
তারা বলেন, বিশ্বজুড়ে করোনার মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। নতুন করে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দিচ্ছে বহু দেশ। অবস্থা উত্তরণ কবে ঘটবে কেউ বলতে পারছেন না।
এ অবস্থায় চাইলেও অনেক শ্রমিকের পক্ষে কর্মস্থলে ফিরে যাওয়া সম্ভব না। ফলে তাদের জীবনকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে না দিয়ে একই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন।
এ জন্য মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্যও বলেছে সংসদীয় কমিটি। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে বৈঠকে জানানো হয়, করোনার কারণে বিভিন্ন দেশ থেকে কাজ হারিয়ে প্রবাসী শ্রমিকদের দেশে ফেরত আসা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
চলতি বছর ১ এপ্রিল থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ লাখ ৯৭ হাজার ৯৮৪ পুরুষ এবং নারী ৪৩ হাজার ৭৭৪ জন নারী শ্রমিক দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। এ ছাড়া আউটপাস নিয়ে দেশে এসেছেন ৪১ হাজার ৫৮৯ জন।
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, মালদ্বীপ, কুয়েত, সিঙ্গাপুর, বাহরাইন, দক্ষিণ আফ্রিকা, কাতার, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, জর্ডান, ভিয়েতনাম, ইতালি, ইরাক, শ্রীলংকা, মরিশাস, রাশিয়া, তুরস্ক, লেবানন, হংকং, জাপান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, লিবিয়াসহ বিশ্বের ২৮টিরও বেশি দেশ থেকে দেশে ফেরত এসেছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। তাদের বেশিরভাগই চাকরি হারিয়ে শূন্য হাতে দেশে ফিরেছেন। আবার অনেকে ছুটিতে দেশে এসে আটকে গেছেন। কেউ কেউ যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, করোনার কারণে তা একেবারে বন্ধই হয়ে গেছে।
বৈঠকে জানানো হয়, করোনায় বিশ্ব পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এই শ্রমিকরা যাতে আবার তাদের কাজের জায়গায় ফিরতে পারেন, সে জন্য কাজ করছে সরকারের কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি।
এ ছাড়া করোনার প্রকোপের কারণে যেসব প্রবাসী শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তাদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে ইতোমধ্যে ২০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে এ টাকা দেয়া হবে। প্রত্যাগত শ্রমিক বা তাদের পরিবারের সদস্যরা সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ সুদে এক লাখ টাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন।
এ ছাড়া বাজেটে প্রবাসীদের জন্য বাড়তি আরও ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। সংসদীয় কমিটি দেশে ফেরত আসা শ্রমিকদের দুর্দশা লাঘবে সরকারের এই উদ্যোগ যাতে স্বচ্ছতা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে সম্পন্ন হয়, এমন পরামর্শ দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কমিটির সভাপতি মুজিবুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘দেশে ফেরত আসা শ্রমিকদের দুর্দশা লাঘবে তাদের পাশে আছি। করোনা মহামারীর কারণে অনেকেই চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। আবার তারা তাদের সেই কর্মস্থলে কবে ফিরে যেতে পারবেন, তাও অনিশ্চিত। এ অবস্থায় কর্মহীন হয়ে পড়া প্রবাসী শ্রমিকদের স্বার্থে সরকার এবং মন্ত্রণালয় বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগ যাতে যথাযথভাবে এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে বাস্তবায়িত হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখা হচ্ছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্র বলছে, প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকেন। কেবলমাত্র মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৫০ লাখ প্রবাসী কাজ করেন।
গত বছরও বিদেশে যাওয়া কর্মীদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ গেছেন মধ্যপ্রাচ্যে। এর বাইরে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী থাকেন মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ ও ইতালি। সব কটি দেশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। প্রবাসীদের একটি বড় অংশ কাজ করে চুক্তিভিত্তিক।
এ ছাড়া কয়েক লাখ আছেন, যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই। তারা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করেন। এখন তাদের? আয় পুরোপুরি বন্ধ। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে দেশে ফিরতে হয়েছে বহু প্রবাসী শ্রমিককে।
জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি- বায়রার মতে, করোনার কারণে দেশে ফিরে চরম আর্থিক সংকটে পড়েছেন অধিকাংশ প্রবাসী শ্রমিক।
উপার্জনের কোনো উপায় না পেয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে রীতিমতো মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের। বিদেশে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্টার্জিত অর্থ দেশে পাঠিয়ে যারা রেমিটেন্সের পাল্লা ভারি করতেন, অবদান রেখেছেন জিডিপিতে, ভাগ্য বিড়ম্বনায় তারাই এখন পড়েছেন চরম আর্থিক সংকটে।
প্রায় ১ বছর হয় দেশে ফিরেছেন এসব শ্রমিক। অনেকেরই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে। এরই মাঝে একটু সহায়তার আশায় কখনও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় কখনও বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দ্বারে দ্বারে ঘুরে মিলেছে শুধুই মৌখিক আশ্বাস। তাই দীর্ঘশ্বাস ও বুকচাপা কান্না নিয়ে দিন অতিবাহিত করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।
জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি- বায়রা মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, ফেরত আসা শ্রমিকদের পুনর্বাসনে দক্ষতা অনুযায়ী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোয় কাজের সুযোগ দিতে হবে। তারা যদি উদ্যোক্তা হতে চান তা হলে তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।