এ এইচ নান্টু, রামপাল প্রতিনিধি :: মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে চীনে কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ ও দাম কমে যাওয়ায় লোকসানে পড়েছেন চাষীরা। লোকসানের মুখে রামপালের প্রায় ৪১৩ খামারি চাষাবাদ বন্ধ করে দিয়েছেন। দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন চাষী ও কাঁকড়া ক্রয় বিক্রয়ের সাথে জড়িত প্রায় ২০ হাজার মানুষ। ব্যাংক ঋণ, এনজিও এবং মহাজনদের চড়া সুদের চাপে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে উপজেলা মৎস্য বিভাগ বলছে ২৩৭ জন কাঁকড়া চাষীকে সহায়তা দিবে সরকার। রামপাল উপজেলার ভাগা গ্রামের কাঁকড়া চাষী পিনাক দাস বলেন, ১১ বিঘা জমিতে আমার ৪টি কাঁকড়ার খামার রয়েছে। ৮ লক্ষ টাকা পুঁজি হারিয়ে আমি এখন নিঃস্ব। বর্তমানে চাষা বন্ধ করে দিয়েছি কিন্তু ব্যাংক ও দাদনদারদের চাপে বাড়িতে ঘুমানোর সুযোগ নেই। কাঁকড়া চাষে ৪৬ লক্ষ টাকা পুঁজি হারিয়ে দিপঙ্কর মজুমদার এখন দুশ্চিন্তায় পড়েছেন, কিভাবে দেনা পরিশোধ করবেন ? কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ থাকায় খামারে চাষ করা কাঁকড়া মরে যাওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান তিনি। দিপঙ্কর বলেন, চিংড়ি চাষে নানা প্রকার রোগ বালাইয়ের কারণে তেমন লাভ হচ্ছিল না। পরে ২০১৮ সালে কাঁকড়া চাষ শুরু করি। লাভ ও ভাল হয়। এক পর্যায়ে ২০১৯ সালের শেষের দিকে বড় আকারে কয়েকটি কাঁকড়া খামার করি। কিন্তু ২০২০ সালে প্রথম দিকে করোনার থাবায় কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। রপ্তানি বন্ধ ও দাম কমে যাওয়ায় সব খামারের কাঁকড়া সময়মত বিক্রি করতে না পারায় সব কাঁকড়া মরে যায়। করোনার প্রকোপ সামান্য কমতে থাকলে গেল বছরের শেষের দিকে ধারদেনা করে আবারো চাষ শুরু করি। কিন্তু উৎপাদিত কাঁকড়া সরাসরি চিনে না যাওয়ায় দাম অর্ধেকে নেমে আসে, যার ফলে কাঁকড়া বিক্রি করে আমাদের উৎপাদন খরচও উঠছে না। দিপঙ্কর মজুমদার ও পিনাকের মতো রামপাল উপজেলায় শতশত কাঁকড়া চাষীদের একই অবস্থার কথা জানান তারা। কাঁকড়া চাষ বন্ধ করেও স্বাভাবিক থাকতে পারছেন না খামারিরা। আর যারা লোকসানের মুখেও কাঁকড়া চাষের সাথে রয়েছে, তারাও বিপুল পরিমান লোকসানে পড়ছেন। কারন কাঁকড়া উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে, কমেছে দাম। এই অবস্থায় চায়না ও হংকং কাঁকড়া রপ্তানি চালু করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও বিনাসুদে ঋণ দিয়ে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার দাবি জানিয়েছেন কাঁকড়া চাষীরা।
বর্তমান বাজার দর হিসাবে রপ্তানিযোগ্য কাঁকড়া সাধারণত ৫টি গ্রেডে বিক্রয় হয়ে থাকে। যা প্রত্যেক গ্রেডে ৬’শ থেকে ৭‘শ টাকা কেজিতে কমেছে। ২‘শ গ্রাম (ফিমেল) ওজনের কাঁকড়ার কেজি ছিল দুই হাজার ২‘শ টাকা সেই কাঁকড়া বর্তমানে ৮‘শ টাকা, একশত ৮০ গ্রামের কাঁকড়া ছিল ১ হাজার টাকা তা বর্তমানে ৬‘শ টাকা, ১‘শ ৫০ গ্রামের কাঁকড়া ছিল ৮‘শ টাকা এখন তা ৪‘শ টাকা, একশ গ্রামের কাঁকড়া ছিল ৬‘শ বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩‘শ টাকায়। এই দামে কাঁকড়া বিক্রি করে চাষীদের যেমন খরচ ওঠে না, তেমনি ব্যবসায়ীদের ও পড়তে হয় ব্যাপক লোকসানে।
বাংলাদেশ কাঁকড়া সরবরাহ সমিতির সাধারণ সম্পাদক অজয় দাস বলেন, সারাদেশে দুই লক্ষাধিক মানুষ কাঁকড়া চাষ ও ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে জড়িত। বাগেরহাটের চাষীদের উৎপাদিত বেশিরভাগ কাঁকড়া বেশি দামে চীনে রপ্তানি করা হত। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারনে রপ্তানী বন্ধ হওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছে চাষী ও ব্যবসায়ীরা। করোনাকালে রামপালের চাষীদের প্রায় কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বন্ধ হয়েগেছে প্রায় ৫ শতাধিক কাঁকড়ার খামার। চীনে কাঁকড়া রপ্তানিসহ সরকারিভাবে সহযোগিতা না পেলে এসব চাষীরা নিস্ব হয়ে যাবে। ক্রমান্বয়ে এই কাঁকড়া উৎপাদনের অনিহা ও বিলুপ্তি হয়ে যেতে পারে বলে সংশয় প্রকাশ করেন অজয় দাস। রামপাল উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শেখ আসাদুল্লাহ জানান, কাঁকড়া একটি লাভজনক ব্যবসা। রামপালে প্রায় ১ হাজারের মতো কাঁকড়া চাষি ছিল। করোনার ছোবলে বিদেশে কাঁকরা রপ্তানি না হওয়ার কারণে আজ অনেকে পুঁজি হারিয়ে সর্বশান্ত। আর যারা টিকে আছে তারা খুব কষ্ট করেই টিকে আছে। যারা সর্বশান্ত তারা অন্য উপায় খুঁজছে বেঁচে থাকার জন্য। এইসব কাঁকড়া চাষিরা যদি ব্যাংক ঝণ পেতো এবং সরকারিভাবে তাদের প্রণোদনা দেওয়া হয় তাহলে হয়তো কাঁকরা চাষিরা কিছুটা হলেও সংকট কাটিয়ে আবারো কাঁকড়া চাষে আগ্রহী হবে। নতুবা আস্তে আস্তে এই কাঁকড়া চাষ বিলুপ্তি হয়ে যাবে। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাধান কুমার বিশ্বাস এই প্রতিবেদককে জানান, বাগেরহাটের রামপালে উৎপাদিত কাঁকড়া চীন, জাপান, মালেয়শিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, কোরিয়ায় রপ্তানি হত। এর মধ্যে চীনেই রপ্তানি হয় ৮০ শতাংশ। হঠাৎ করে চীনে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে চাষী ও ব্যবসায়ীরা যেমন বিপাকে পড়েছেন তেমনি সরকারও হারাচ্ছে বিপুল রাজস্ব। আমরা উপজেলা প্রশাসন আন্তরিকভাবে তাদের খোঁজখবর নিয়েছি। ইতিমধ্যে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত কাঁকড়া চাষিদের ২৩৭ জনের একটি তালিকা করে প্রণোদনার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করেছি। আশা করি সরকারিভাবে তাদের সহায়তা করা হবে।