প্রতিবেদক
একটি মামলায় জামালপুরের স্কুলশিক্ষক আজমত আলীর যাবজ্জীবন সাজা হয়। ১০ বছর সাজা ভোগের পর রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমায় কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। কিন্তু মুক্তি পাওয়ার ১৩ বছর পর আবারও তাঁকে কারাগারে যেতে হয়। এ দফায় প্রায় ১০ বছর কারাভোগ শেষে আজ মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জামালপুরের জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন তিনি। কেন আবার ১০ বছর কারাভোগ করতে হলো, তার বিচার চাইলেন তিনি।
আজমত আলী মুক্তি পাবেন—এ খবর শুনে আজ সকাল নয়টার দিকে জামালপুর জেলা কারাগারে গিয়ে দেখা যায়, কারাফটকে আজমত আলীর আত্মীয়-স্বজন ও গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে চার দেয়ালের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন আজমত। গেটের বাইরে পা ফেলেই তিনি প্রথমে আকাশের দিকে তাকান। মেয়ে বিউটি আক্তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
যাবজ্জীবন সাজার রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আজমত আলীর পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির করা আবেদন নিষ্পত্তি করে গত ২৭ জুন আপিল বিভাগ একটি রায় দেন। ওই আদেশের ভিত্তিতে তাঁকে তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তি দিতে গতকাল সোমবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার মো. আবু তাহের নির্দেশনা পাঠিয়েছেন। বিশেষ ডাকযোগে ওই নির্দেশনা আজ বেলা ১১টার দিকে জামালপুরের জেল সুপার মো. মকলেছুর রহমানের কাছে যায়। নির্দেশনা পাওয়ার ৩০ মিনিটের মধ্যে তাঁকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
মুক্তি পেয়ে আজমত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুক্তি পাওয়াটা আনন্দের বিষয় হলেও আমার জন্য খুবই দুঃখের বিষয়। আমার জীবনটা কারাগারেই কেটে গেছে। আমার ১০টি বছর কারাগারে হারিয়ে গেছে। লেখাপড়া করে আমি কী করতে পারলাম? জীবন তো কারাগারেই শেষ। ৭০ হাজার বন্দী মুক্তি পেয়েছেন, আমিও পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি নিজেও বুঝতে পারিনি আমাকে কেন আবার ১০টি বছর কারাভোগ করতে হলো? আমি এই বিচার চাই।’
আজমত আলীর মেয়ে বিউটি আক্তার বলেন, ‘মুক্তি পাওয়ার পরও আমার বাবাকে ১০টি বছর জেল খাটতে হলো। তাঁর জীবনটা জেলেই গেল। তিনি এখন বৃদ্ধ। জীবনে কিছুই করতে পারলেন না। তাঁর জীবনের ১০টি বছর ফেরত চাই।’
জেল সুপার মো. মকলেছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৮ সালে এই কারাগারে যোগদানের পর আজমত আলীর বিষয়টি আমার দৃষ্টিতে আসে। পরে কারাগারেই আমি আজমত আলীর সঙ্গে পুরো বিষয়টি আলোচনা করি। পরে তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাঁর সব কাগজপত্র সংগ্রহ করি এবং সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিই। সেই থেকে আমরা বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর রেখেছি। আজমত আলীর পরিবারের সঙ্গে আমরাও অনেক খুশি।’
প্রসঙ্গত, জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার তারাকান্দি এলাকার পাখিমারা গ্রামের বাসিন্দা আজমত আলী। তাঁর বয়স এখন ৭৪ বছর। টাঙ্গাইলের গোপালপুর ঘোড়ামারা এলাকার ভেঙ্গুলা উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন তিনি। ১৯৮৭ সালের ১ এপ্রিল জমি নিয়ে বিরোধের জেরে এলাকার কলিম উদ্দিনের ছেলে রেজাউল করিম নিহত হন। এই ঘটনায় আজমত আলীকে আসামি করে হত্যা মামলা করা হয়। এ মামলায় ১৯৮৯ সালের ৮ মার্চ জামালপুরের জেলা ও দায়রা জজ আদালত তাঁকে যাবজ্জীবন সাজা দেন। বিচারিক আদালতের সাজার রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন আজমত আলী। একই সময় তিনি রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমার জন্যও আবেদন করেন। আপিল বহাল থাকার সময় রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় ১৯৯৬ সালের ২১ আগস্ট জামালপুর কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। ২০০৫ সালের ২ মার্চ হাইকোর্টের রায়েও তিনি খালাস পান। এভাবে ১৩ বছর কেটে যায় তাঁর।
কিন্তু হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ, যার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ২০০৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আজমত আলীকে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেন। ২০০৯ সালের ১৯ অক্টোবর গ্রামের বাড়ি থেকে আজমতকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ। সেই থেকে কারাগারে ছিলেন তিনি।