২০১৬ সালে রুখসানার মাথায় ওঠে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মুকুট। এখন তিনি অনেকের কাছেই আদর্শ। কিন্তু যে জীবন পেছনে ফেলে এসেছেন সিলেটের এই মেয়ে, সেটাকে বক্সিংয়ের চেয়েও বড় মনে হয় তার কাছে। তাই তো অদম্য এই যোদ্ধা বলেন, ‘আমার গল্প বক্সিংয়ের চেয়েও বড়।
চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃ রিংয়ে নেমে কেবল প্রতিপক্ষকেই দেখেন না। প্রতিপক্ষের চেহারায় হয়তো জীবনের সব অসংলগ্নতা আর অন্যায়ও দেখতে পারেন রুখসানা বেগম। তাই জবাবটা সেভাবেই দিতে চান, যেভাবে আগে দিতে পারেননি। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কিক বক্সার রুখসানার জীবন যুদ্ধের গল্প পড়লে যে কারও কাছেই এমন মনে হবে।
ক্ল্যাইম্যাক্স দিয়ে ভরা রুখসানার জীবন। তার জীবন যুদ্ধ বলে দেয়, বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া মেয়েদের কতটা কঠিন পথ মারিয়ে সামনে এগোতে হয়। যদিও রুখসানার জন্ম লন্ডনে। কিন্তু তার গল্পও বাংলাদেশের মেয়েদের চেয়ে আলাদা নয়। অল্প বয়সে বিয়ে, অতঃপর ছাড়াছাড়ি। এরপর আসল নিজেকে খুঁজে নিয়ে রুখসানার স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাওয়ার গল্প।
জীবনের কঠিন অধ্যায়েও হার না মানার কারণে ইংল্যান্ডে রুখসানাকে ডাকা হয় ‘ওয়ারিওর প্রিন্সেস’ নামে। কিং বক্সিংয়ে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপাসহ অনেক সাফল্য কুড়িয়েছেন রুখসানা। গত চার বছর ধরে ব্রিটিশ জাতীয় মুয়ে থাই (কিক বক্সিংয়েরে বিশেষ একটি খেলা) দলের অধিনায়ক তিনি।
বেশ কয়েকবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ খেলা রুখসানার বায়োগ্রাফি ‘বর্ন ফাইটার’ প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। বর্ন ফাইটার প্রকাশিত হওয়ার পর ব্রিটিশ মিডিয়ায় রুখসানাকে নিয়ে হইচই পড়ে গেছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই কিক বক্সার। গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জীবনযুদ্ধের কঠিন অধ্যায়ের গল্প শুনিয়েছেন ৩৬ বছর বয়সী রুখসানা।
রুখসানার বয়স যখন ২৩, তখন তাকে পারিবারিকভাবে বিয়ে দেওয়া হয়। রাজি না থাকলেও লন্ডনের এক ব্যাংকারের সঙ্গে জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করতে হয় তাকে। কিন্তু এই অধ্যায়টা সুখের হয়নি রুখসানার। স্থাপত্যে ক্যারিয়ার গড়ার লক্ষ্যে লেখাপাড়া চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু সংসার ও লেখাপড়া একসঙ্গে চালানো প্রায় অসাধ্য হয়ে ওঠে রুখসানার জন্য।
খুব কঠিন সময়ের মধ্যে পড়ে যাওয়া রুখসানা হতাশায় ভুগতে শুরু করেন। অবসাদ গিলে নেওয়ায় বাবা-মায়ের কাছে একটু শান্তির খোঁজে ফেরেন জীবন যুদ্ধের লড়াকু এই যোদ্ধা। কিন্তু বাবা-মাও তাকে স্বামীর কাছে পাঠাতে উঠেপড়ে লাগেন। এরমাঝেই মুক্তি মিলে যায় রুখসানার। স্বামীর পাঠানো ডিভোর্স লেটার হাতে পান তিনি।
চনমনে হয়ে ওঠে রুখসানার মন। গার্ডিয়ানকে জীবনের এই কঠিনতম অধ্যায়ের কথা বলতে গিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দেন রুখসানা। বাংলাদেশি এই অগ্নিকন্যা বলেন, ‘আমি তখন ২৩ বছর বয়সী। আমার বিয়ে ঠিক হয়, যা খুব কঠিন ছিল। মনে হচ্ছিল বড় করে নিশ্বাস নিতে হবে কারণ তাকে আমি চিনি না। রাজ্যের চাপ অনুভব করছিলাম। মায়ের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তিনি আমাকে দূরে সরিয়ে দেন। পরিস্কার করে বলে দেন, এটাই হতে যাচ্ছে।’
স্বামীর ঘরে রীতিমতো অত্যাচারিত হতেন রুখসানা। কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও ভয়ে কাউকে কিছু বলতেন না, ‘আমি সেখানে নিপীড়িত ছিলাম। আমার এটাও বলার স্বাধীনতা ছিল না যে, আমি খুব ক্লান্ত; এক ঘণ্টার মধ্যে কাজটা করে নিবো। আমি ক্রমাগতভাবে তাদের খুশি করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সেসব যথেষ্ট ছিল না। ওই সময় আমি নবিস স্থপতি হিসেবে একটা কাজে যোগ দিই, যেখানে খুব চাপ ছিল। যেটার প্রভাব আমার ওপর পড়ে।’
এতটাই প্রভাব পড়ে যে, রুখসানার আচরণে পরিবর্তন চলে আসে। সামান্য কিছুতেই আতঙ্কিত হয়ে পড়তেন তিনি। মেয়ের অবস্থা বুঝতে পেরে চিকিৎসা শুরু করান বাবা-মা। সুস্থ হয়ে উঠলে পুরনো শখ কিক বক্সিংকে বেছে নেন পেশা হিসেবে। শুরু করেন পেশাদার পথচলা।
আগে থেকেই কিক বক্সিংয়ের প্রতি ভালোবাসা ছিল রুখসানার। কলেজ শেষ করে কিক বক্সিংয়ের ক্লাস করতেন তিনি। পরিবারের সমর্থন মিলবে না ভেবে প্রথম দিকে কিক বক্সিংকে শখের পর্যায়েই সীমাবদ্ধ রাখেন তিনি। পরে পরিবারকে বুঝিয়ে নিজের ভূবনে লড়াই করতে নামেন রুখসানা।
২০০৯ সালে প্রথম শিরোপা জেতেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই কিক বক্সার। থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অ্যামেচার কিক বক্সিংয়ে মালয়েশিয়ার এক বক্সারকে হারিয়ে শিরোপা জেতেন রুখসানা। পরের বছর ব্রিটিশ মুয়ে থাই কিক বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জেতেন তিনি। এর পরের বছর গিয়ে আরও বড় সাফল্য মেলে তার।
২০১১ সালে জেতেন ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ। যদিও এ পথে তার সঙ্গী ছিল না কেউ। রিংয়ে রাউন্ডের লড়াইয়ের শেষে পানি এগিয়ে দেওয়ার মতো কেউ ছিল রুখসানার সঙ্গে। কয়েক রাউন্ড পর রুখসানার খেলা দেখে ভালো লাগায় তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন এক ডেনিস কোচ।
এরপর আর কঠিন সময় পার করতে হয়নি রুখসানাকে। রিংয়ে কেবলই শাসন করে গেছেন সিলেটের বালাগঞ্জের এই মেয়ে। ২০১৬ সালে তার মাথায় ওঠে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মুকুট। এখন তিনি অনেকের কাছেই আদর্শ। কিন্তু যে জীবন পেছনে ফেলে এসেছেন রুখসানা, সেটাকে বক্সিংয়ের চেয়েও বড় মনে হয় তার কাছে। তাই তো অদম্য এই যোদ্ধা বলেন, ‘আমার গল্প বক্সিংয়ের চেয়েও বড়।