কালের আবর্তে হারিয়ে যেতে বসেছে প্রতিটি পরিবারের এক সময়ের নিত্যসঙ্গী মাটির চুলা। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন শহরের মানুষ বিদ্যুৎ বা গ্যাসের চুলার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যদিও কিছু গ্রামাঞ্চলে এখনও এর ব্যবহার রয়েছে, তবে ইট-পাথরের শহর থেকে মাটির চুলা প্রায় নির্বাসিত। তারপরও খুলনার শেরে-বাংলা সড়কের পাশে এখনও কিছু কারিগর মাটির চুলা তৈরির ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।
মাটির চুলার কারিগর আব্দুল হাকিম সিকদারের গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের মোরলগঞ্জ উপজেলায়। ছোটবেলায় বাবার সাথে খুলনায় আসেন এখানেই তার বেড়ে ওঠা। একসময় রিকশা চালাতেন। কিন্তু রিকশা চালিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। তবে তার স্ত্রী তখন মাটির চুলা তৈরি করতেন। স্ত্রীর পরামর্শেই আব্দুল হাকিম সিকদার এই পেশায় আসেন। আব্দুল হাকিম সিকদার জানান, যখন তিনি এই পেশায় আসেন তখন প্রচুর মাটির চুলার চাহিদা ছিল। আমরা চুলা তৈরি করতেই হিমশিক খেতাম। এখানে তখন মোট ১৭ টি মাটির চুলা তৈরির দোকান ছিল। তবে এখানে এখন মাত্র ৪টি দোকন আছে। ধিরে ধিরে বিক্রি কমতে কমতে এ পেশা থেকে সড়ে গেছে অনেকেই।
আব্দুল হাকিম সিকদার বলেন, এখন আর আগের মতো চাহিদা নেই। আগে খুলনায় গ্যাসের অভাবে সবাই মাটির চুলা ব্যবহার করত, কিন্তু এখন সিলিন্ডার গ্যাস সহজলভ্য হওয়ায় কেউ আর এই চুলা নিতে চায় না।
খুলনার ময়লাপোতা এলাকায় প্রায় ৫০ বছর ধরে মাটির চুলা তৈরি করছেন কারিগররা। তাদের মধ্যেই একজন ফাতেমা বেগম, যিনি প্রায় ৩৮ বছর ধরে এই পেশায় আছেন। ফাতেমা বেগম বলেন, একসময় এখানে মাটির চুলা বিক্রি হত মাত্র ৫-৬ টাকার বিনিময়ে। তবে এখন প্রতিটি চুলার দাম ১৫০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই চুলা তৈরির মাটি সংগ্রহ করা হয় নদী থেকে।নদীর এটেল মাটিতে চুলা ভালো হয়।
ফাতেমা বেগম বলেন, শীতের মৌসুমেই মাটির চুলার চাহিদা বেশি থাকে। এই সময় মাসে ৬০-৭০টি চুলা বিক্রি হয়। কিন্তু বছরের অন্য সময় বিক্রি প্রায় নেই বললেই চলে। এই কাজ করেই জীবন চলে। বছরের বেশির ভাগ সময় কাজ থাকে না। শুধু শীতের সময় কিছুটা চাহিদা থাকে।” শহরের প্রায় প্রতিটি ঘরেই এখন সিলিন্ডার গ্যাস বা বৈদ্যুতিক চুলা ব্যবহার হয়। ফলে মাটির চুলার বাজার ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। তবে গ্রামাঞ্চলে এখনও কিছু পরিবার মাটির চুলা ব্যবহার করে।
স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ” আমার বাসায় মাটির চুলা এবং গ্যাসের চুলা দুটাই আছে। আমি মাটির চুলাতেই বেশি রান্না করি। এতে খাবার স্বাদ ভালো থাকে তবে শাঝে মাঝে গ্যাসের চুলাতে রান্না করি।
মাটির চুলা কিন্তে আসা এক ক্রেতা বলেন, আগে আমাদের বাসায় সব রান্না হতো মাটির চুলায়, এখন আর কেউ ব্যবহার করে না। তবে শীতের সময় পিঠাপুলি বানানোর জন্য মাটির চুলার প্রয়জন। মাটির চুলাতে বেশি রান্না করা যায় আর ভালো পিঠা বানানো যায়। তাই মাটির চুলা কিনতে এসেছি।” প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে মাটির চুলার ব্যবহার কমে গেছে, ফলে এই পেশার সাথে জড়িত কারিগরদের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। তবে শীতের সময় কিছুটা চাহিদা থাকলেও সারা বছর তেমন বিক্রি নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ঐতিহ্যবাহী পেশা কি হারিয়ে যাবে, নাকি টিকে থাকবে নতুন কোনো প্রয়োজনে? সময়ই হয়তো সেই উত্তর দেবে।