চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃজাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইট বলছে বাংলাদেশে প্রতিবছর দেড় লাখের কাছাকাছি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় আর মারা যায় ৯০ হাজারের বেশি। খুলনায়ও প্রতিবছর জ্যামিতিক হারে বাড়ছে ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা। বর্তমানে যা ভয়ঙ্কর রুপ নিয়েছে। অথচ দীর্ঘমেয়াদে অতি ব্যয়বহুল এ রোগের কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছে না খুলনার মানুষ। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বল্প পরিসরে ক্যান্সার চিকিৎসা দেয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুলনায় মহামারী আকারে ক্যান্সার ছড়ানোর আগে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যান্সার ইউনিট সূত্রমতে, ২০১৮ সালে খুলনা বিভাগে বিভিন্ন স্থান থেকে ক্যান্সার আাক্রান্ত ২ হাজার ২৫৯ জনকে কেমোথেরাপী দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে পুরুষ ৯৪১ জন ও মহিলা রয়েছে ১ হাজার ৩১৮ জন। এছাড়া ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩ হাজারের বেশি। গত ৫ বছরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে রেডিও থেরাপি বিভাগ থেকে কেমোথেরাপি নেয়া রোগীদের সংখ্যা পর্যালোচনা করলে দেয়া যায়, প্রতি বছরই ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। ২০১৪ সালের ২০ অক্টোবর পর্যন্ত নতুন পুরাতন মিলিয়ে মোট ১৩৬ জন ক্যান্সার রোগীকে কেমোথেরাপী দেয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে ৮৩৯ জন, ২০১৬ সালে সেই সংখ্যা এক হাজার ওপরে এবং ২০১৭ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৫৬ জনে।
খুলনায় ক্যান্সার চিকিৎসা : যেখানে খুলনায় নতুন পুরাতন মিলে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী বাড়ছে সেই তুলনায় চিকিৎসক নেই বললেই চলে। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যান্সার ইউনিটে রেডিওথেরাপি বিভাগে ডাঃ মুকিতুল হুদা নামে একজন সহকারী অধ্যাপক রয়েছেন। খুলনায় তার নিয়মিত পোস্টিং থাকলেও তিনি খুলনায় নিয়মিত বসেন না। সপ্তাহের তিন দিন খুলনায় ও ৪দিন থাকেন ঢাকায়। সোম, মঙ্গল ও বুধবার একদিকে বহির্বিভাগে আসা রোগীদের পরামর্শ প্রদান করেন অন্যদিকে ক্যান্সার ইউনিটে রোগীদের কেমোথেরাপি দিয়ে থাকেন।
গতকাল সোমবার তার ক্যান্সার ইউনিটে গিয়ে দেখা যায় রোগীদের ভিড়। এখানে ৮টি বেডের প্রতিটিতে রয়েছে অন্তত দুইজন রোগী। এছাড়া ফ্লোরেও রয়েছেন কয়েকজন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডাঃ মুকিতুল হুদা এখানে কেমোথেরাপি দিলেও চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সব কিছু রোগীদের বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। কেমোথেরাপির জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহের জন্য ওষুধ কোম্পানির লোক এখানে সার্বক্ষণিক থাকে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্যান্সার আক্রান্ত হয় শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরণীরা। এদের মধ্যে কোলন ও লিভার ক্যান্সার বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোমল পানীয়র কারণেও ক্যান্সার হচ্ছে। এই কোমল পানীয়র মধ্যে অসিলা টক্সিন নামের একটি উপাদান থাকে। এটি লিভার ক্যান্সার সৃষ্টি করে। বর্তমান সময়ে নাক, কান, গলা ও ফুসফুসের ক্যান্সারের সংখ্যা বেশি। মহিলাদের ব্রেস্ট ও জরায়ুর মুখে ক্যান্সার হয়। শিশুদের মধ্যে লিউকোমিয়া ও চোখের ক্যান্সার বেশি হয়। গরীব ও মধ্যবিত্তের পক্ষে চিকিৎসা চালিয়ে নেয়া সম্ভব হয় না। আর সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব রয়েছে।
২৪ কোটি টাকার রেডিও থেরাপি মেশিন : খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যান্সার ইউনিটে রেডিও থেরাপির জন্য আনা ২৪ কোটি টাকার লিনিয়র এক্সেলেটর মেশিনটি রোদে শুকিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে তার আয়ুষ্কাল শেষ হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ক্রয় করা এ মেশিনটি মাত্র ৫ কোটি টাকার জন্য প্রায় ৮ বছর ধরে অনকোলজি বিভাগের বারান্দায় পড়ে থাকতে থাকতেই জীবনকাল শেষ করলো। মহাখালী ক্যান্সার হাসপাতালে ফেরত নিয়ে যাবে সেই প্রক্রিয়া করতে করতে বছর দুই পার হলো। তাও নিতে পারলো না। অথচ ২৪ কোটি টাকায় কেনা এ মেশিনটির সুফল পায়নি এ অঞ্চলের রোগীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে বাঙ্কার না বসিয়ে অপরিকল্পিতভাবে মেশিন কেনার কারণে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে খুলনায় চিকিৎসকদের একটি সমাবেশে বক্তৃতাকালে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছিলেন, প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে লিনিয়র এক্সিলেটর মেশিন স্থাপন করা হবে। কিন্তু সেটিও হয়নি। মেশিনটি প্রতিস্থাপন এবং আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সাড়ে সাত কোটি টাকা চাওয়া হয়। যার মধ্যে ৫ কোটি টাকা মেশিনের অন্যান্য অংশ ও ২ কোটি টাকা অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়। কিন্তু সে উদ্যোগ ও আর আলোর মুখ দেখেনি।
অনকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ মোঃ মুকিতুল হুদা বলেন, বর্তমানে যে লিনিয়র এক্সিলেটর মেশিনটি এখানে পড়ে আছে সেটি ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হবে আর ঢাকা থেকে আর একটি মেশিন এখানে আসবে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে। খুলনায় পড়ে থাকা মেশিনটি যেহেতু খুমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেনি সেহেতু কোম্পানির পক্ষ থেকে একজনকে দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে। ওই ব্যক্তিই মেশিনটি পাহারা দিয়ে রাখছেন কোম্পানির খরচে।
বাংলাদেশ মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) খুলনা শাখার সাধারণ সম্পাদক ডাঃ মোঃ মেহেদী নেওয়াজ বলেন, ইতিমধ্যেই লিনিয়র এক্সিলেটর মেশিনটির ওয়ারেন্টি পিরিয়ড শেষ হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট কোম্পানি জামানতের টাকাও পায়নি। সুতরাং এটি এখন এখানে বসানোও ঝুঁকিপূর্ণ। সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে অনুযায়ী নতুন একটি কোবাল্ট মেশিন বসানোই ঠিক হবে।