শেখ মাহতাব হোসেন:: খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলায় বেড়েছে সরিষার চাষ, ভালো ফলনে কৃষকের আনন্দের হাসি। মৌমাছি মৌমাছি, কোথা যাও নাচি নাচি… কবিতার এই পঙক্তির মতো মাঠে মাঠে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত মৌমাছির দল। দিগন্তজোড়া মাঠে হলুদের সমারোহ। যতদূর চোখ যায় শুধু হলুদ আর হলুদ। সরিষার হলুদ ফুলে শীতের সোনারাঙা রোদের ঝিকিমিকি মৌমাছিকে হাতছানি দেয়। মৌমাছিরা মধু সংগ্রহে ছুটে যায়। অন্যদিকে হলুদ-সবুজের মিতালি মাখা সরিষা ক্ষেত, কৃষকের চোখে-মুখে নতুন স্বপ্নের রং ছড়িয়ে দেয়। সারা দেশের ন্যায় দেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় ডুমুরিয়া উপজেলা জুড়ে এ বছর সরিষার ভালো ফলনে কৃষকের মুখে হাসি। এ বছর ডুমুরিয়া উপজেলায় সরিষার আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে এবং ফলন বেশ ভাল হয়েছে। দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। সয়াবিন তেলের মূল্য নিয়ে চলছে তেলেসমাতি।
এ জন্য কৃষক এবার সরিষা আবাদের দিকে ঝুঁকছে। উপজেলা ব্যাপী টরি সরিষা – ৭, বারি সরিষা- ১৪, বারি সরিষা-১৭, বারি সরিষা-১৯, বিনা সরিষা-৪, বিনা সরিষা- ৯ সহ বিভিন্ন জাতের সরিষা আবাদ অনেক বেশি হয়েছে, ফলনও ভাল হয়েছে। দেশে ভোজ্যতেলের মোট চাহিদার সিংহভাগই আমদানিনির্ভর। আমদানিতে এগিয়ে সয়াবিন ও পাম অয়েল। এতে বছরে অনেক টাকা ব্যয় হচ্ছে সরকারের। তবে সরিষার উৎপাদন বাড়িয়ে এ ব্যয় অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। দেশে উৎপাদিত তেলের মধ্যে সরিষা শীর্ষে। এছাড়া সয়াবিন, সূর্যমুখীসহ দু’-একটি অপ্রচলিত তেলবীজের চাষ হয় সামান্য। দেশের ভোজ্যতেলের প্রায় ৬০ ভাগ আসে সরিষার তেল থেকে এবং এটিই আমাদের ভোজ্যতেলের প্রধান ফসল। বিভিন্ন জাতের সরিষা বীজে ৩৮ থেকে ৪৫ শতাংশ তেল থাকে আর বাকিটা খৈল। এই খৈলে ৪০ শতাংশ থাকে আমিষ। এই খৈল গৃহপালিত পশুর জন্য পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে প্রতি হেক্টরে সরিষার ফলন হয় ১০০০ থেকে ১৫০০ কেজি। আমন ও বোরো চাষের মাঝের সময়ে বড় অংশ জমি পতিত থাকে। এ পতিত জমি ব্যবহার করে দেশে তেলবীজের উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি নির্ভরতা অর্ধেকে আনতে ৩ বছর মেয়াদি রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করছে সরকার। রোডম্যাপ বাস্তবায়নে এরই মধ্যে বেশ কিছু তেলজাতীয় ফসলের সঙ্গে সরিষার আবাদ ব্যাপকভাবে বাড়ানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। আর তাতে সুফলও মিলতে শুরু করেছে। এ বছর সারাদেশের ন্যায় ডুমুরিয়া উপজেলায়ও ব্যাপকভাবে বেড়েছে সরিষার চাষাবাদ।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতার কারণে দেশে ভোজ্যতেলের বাজারও গত বছর থেকে বেশি অস্থিতিশীল। ভোক্তারা তেল কিনেছেন রেকর্ড দামে। সেটার একটি প্রভাব পড়েছে সরিষা চাষে। গত এক বছরের তুলনায় সরিষা বীজের দাম প্রতি মণে বেড়েছে প্রায় এক থেকে দেড় হাজার টাকা। সে কারণেও চাষিরা সরিষা চাষে আগ্রহী হয়েছেন। সয়াবিন ও পাম তেলের দাম দ্রুত বাড়ায় দেশে সরিষার তেলের চাহিদা বেড়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্য সচেতন অনেক মানুষ এখন সরিষার তেল বেছে নিচ্ছেন। এখন সয়াবিনের দাম যে ভাবে বাড়ছে তাতে আবারও মানুষ সরিষার তেলের প্রতি ঝুঁকছে। যদি সরিষার উৎপাদন বাড়ানো যায় তাহলে আগের মতো মানুষ আবার সরিষার তেলই খাবে। সরিষা চাষে কৃষক লাভবান হচ্ছেন। উচ্চ ফলনশীল উন্নত জাতের সরিষা চাষ করে ফলন যেমন বেশি হচ্ছে তেমনি দামও ভাল পাচ্ছে কৃষক। বাজারে ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি, সরিষার ভালো দাম পাওয়া, উন্নত জাতের কারণে স্বল্পসময়ে অধিক ফলন, কম খরচ ও অল্প পরিশ্রমে ফসল পাওয়ায় এখন সরিষা চাষে দেশের কৃষক বেশ আগ্রহী হচ্ছে। উপজেলার বেশিরভাগ জমিতে আমন ও বোরো চাষ হয়। দুই ধান চাষের মাঝখানের মৌসুমে প্রায় দুই মাস জমি পতিত থেকে যায়। এ বছর এ দুই ফসলের মধ্যে প্রচুর এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে সরিষা চাষ হয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন হলুদ রঙের সরিষা ফুলের সমারোহ। সরিষা আবাদের পাশেই মৌ চাষের প্রচলনও বেড়েছে। মাঠের পাশে বাক্স বসিয়ে মৌ চাষিরা মধুও সংগ্রহ করছেন। ফলে সরিষা চাষি ও মৌচাষি উভয়ই লাভবান হওয়ায় সরিষা চাষে কৃষকের আগ্রহ বেড়েছে। বাজার ফেরত ক্রেতাদের মতে দেশে তেল উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট, ভোজ্যতেলের সিন্ডিকেটের কারণে যে নিয়ন্ত্রণহীন বাজার তাও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে নিজের উৎপাদিত তেলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে।
ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোঃ ইনসাদ ইবনে আমিন বলেন, উপজেলায় ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ৪৫৭ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হচ্ছে। তিনি আরো জানান গত মৌসুমে ডুমুরিয়া উপজেলায় ৪০০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছিল। তিনি বলেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে কৃষক যেন অধিক ফলন পেতে পারে এ ব্যাপারে সার্বক্ষনিক কৃষকের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে উপজেলা কৃষি অফিস। আশা করছি এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে সরিষা চাষে বাম্পার ফলন পাবে চাষিরা।