শেখ মাহতাব হোসেন:: খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলায় মলা ঢেলা মাছের বাম্পার দাম পেয়ে মৎস্য চাষীদের মুখে হাসি। দেশীয় প্রজাতির মাছ মলা। এটি খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি এ মাছ বেশ পুষ্টি সমৃদ্ধ। তাই ডাক্তাররা মলা ঢেলা মাছ খেতে রোগীদের পরামর্শ দেন। আমাদের দেশের খাল-বিল কমে যাওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে এখন মলা মাছ তেমন একটা পাওয়া যায় না। কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি আবিষ্কার হওয়ার ফলে মলা মাছ এখন বড় পরিসরে চাষাবাদ শুরু হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছ। মৎস্য অধিদপ্তরের খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল বলেন, মলা মাছের পোনা পরিবহন করা একটি জটিল
পদ্ধতি এবং রেনু পরিবহন করা অত্যন্ত সহজ তাই রেনু নিয়ে নিজে পোনা তৈরি করে চাষাবাদ করাই উত্তম। এতে খরচ ও ঝুঁকি দুটোই কম।
যারা অল্প খরচে মলা মাছ চাষ করতে চান তারা প্রথম দিন হতে ৭ থেকে ৮ দিন পর রেনু ছাড়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে প্রথমে পুকুরে বিষটোপ ব্যবহার করে সব রাক্ষুসে মাছ মেরে ফেলুন। তারপর পুকুরের সব পানি সেচ দিয়ে ফেলে দিতে হবে। যদি পুকুরের আকৃতি বড় হয় তাহলে সব পানি অপসারণ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে। এক্ষেত্রে অর্ধেক পানি ফেলে দিয়ে পরিস্কার পানি দিয়ে ভরে দিতে হবে। যদি পানি পরিবর্তন করার কোনো সুযোগ না থাকে তাহলেও চলবে। সেক্ষেত্রে চুনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে। বিষটোপ প্রয়োগের দ্বিতীয় দিন শতাংশ প্রতি আধা কেজি চুন পানিতে গুলে ছিটিয়ে দিতে হবে।
ডুমুরিয়া উপজেলা খর্নিয়া ইউনিয়নের গোনালী গ্রামের মলা ঢেলা মাছ চাষী শেখ হাফিজুর রহমান জানান, তারা ডুমুরিয়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার মো. আবুবকর সিদ্দিকের পরামর্শ নিয়ে মলা ঢেলা মাছের চাষ করে চলতি বছরে ১১ ডিসেম্বার ২০২৩ সকালে ১০হাজার টাকার মলা ঢেলা মাছ বিক্রিয় করেছেন। উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে আগামীতে আরো বেশি করে মাল ঢেলা মাছের চাষ করবেন।
ডুমুরিয়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার মো. আবুবকর সিদ্দিক বলেন, আমাদের খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলায় মলা ঢেলা মাছ চাষ করে ডুমুরিয়া উপজেলার অনেক মৎস্য চাষীরা লাভবান হয়েছেন। তবে যদি পুকুর অথবা ঘের বেশি পুরাতন হয় এবং পানি পরিবর্তন করার সুযোগ না থাকে সেক্ষেত্রে শতাংশ প্রতি ১ কেজি পরিমাণ চুন দেয়া ভালো। বিষ টোপ প্রয়োগের ষষ্ঠ দিনে হাসপোকা মারার জন্য সুমিথিয়ন ব্যবহার করতে হবে পুকুরে। ০.৩ পিপিএম মাত্রায় সুমিথিয়ন ব্যবহার করতে হবে। অনেকেই হাসপোকার মারার জন্য অন্য ঔষধ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। মলা ঢেলা মাছের ক্ষেত্রে সুমিথিয়ন ভালো। সুমিথিয়ন সন্ধ্যা বেলায় প্রয়োগ করতে হবে। এর দুদিন পর পুকুরে রেনু ছাড়তে হবে।
প্রথমে পানি ভর্তি রেনুর ব্যাগ পুকুরের পানিতে আধাঘণ্টা ভাসিয়ে রাখতে হবে পুকুরের পানির তাপমাত্রা সামঞ্জস্য হওয়ার জন্য। আধাঘণ্টা পর ব্যাগের মুখ খুলে ব্যাগের পানির ভিতর হাত ঢুকিয়ে এবং পরে পুকুরের পানিতে হাত ঢুকিয়ে ব্যাগ ও পুকুরের পানির তাপমাত্রা একই মনে হবে তখন পুকুরের পানি দিয়ে অল্প অল্প করে ব্যাগে ঢুকিয়ে আবার বের করে এভাবে রেনু ধীরে ধীরে ছাড়তে হবে। এভাবেই রেনু ছাড়ার কাজ শেষ করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, রেনু ছাড়ার ২ ঘণ্টা পর খাবার দিতে হবে। দিনে দুইবার খাবার দিতে হবে। সকাল ১০টার দিকে এবং বিকাল ৫টার সময়। খাবার হিসেবে প্রথম ২ দিন ডিম (সাদা অংশসহ) খেতে দিতে হবে। এ জন্য প্রথমে হাঁসের ডিম সিদ্ধ করে ব্লেন্ডার দিয়ে ভালো করে ব্লেন্ড করে পলেস্টার কাপড় দিয়ে ছেঁকে মিহি মতো করে পানির সঙ্গে মিশিয়ে পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।
প্রতি ৫ শতাংশে একটি করে ডিম দিতে হবে। তৃতীয়দিন থেকে নার্সারি পাউডার ৩-৬ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। প্রতি ১০ শতাংশে ১ কেজি খাবার দিতে হবে দিনে দুইবার ভাগ করে। ১০ দিন পর খাবার প্রতি ১০ শতাংশে ১.৫ কেজি খাবার দিতে হবে। এভাবে চলবে ২০ থেকে ২৫ দিন পর্যন্ত। এরপর খাদ্য প্রয়োগের কৌশল বদলাতে হবে।
পরিবর্তিত খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি ২৫ দিন পর থেকে এক সপ্তাহের খাবার এক সঙ্গে পুকুরে ভিজিয়ে রেখে খাওয়াতে হবে। যেহেতু মলা ঢেলা মাছ ফাইটোপ্লাংকটন ভোজী তাই একটু ভিন্নভাবে খাবার দেয়া দরকার। ধরা যাক ১ সপ্তাহের জন্য ১০০ কেজি খাবার প্রয়োজন।
আর নার্সারি পাউডারের মতো দামি খাবার খায়াবেন না। তাই ১০০ কেজি সরিষার খৈলকে সাতটা বস্তায় সমান ভাগ করে প্রতি বস্তায় ৪ কজি ইউরিয়া সার খৈলের সঙ্গে মিশিয়ে পানিতে খুঁটিতে বেঁধে রাখলে তিনদিন পর এই খৈলের বস্তা পানিতে ভেসে উঠবে।
তারপর এক এক বস্তার খৈল প্রতিদিন দুই বেলা দিতে হবে। এতে প্লাংকটনের বৃদ্ধির পাশাপাশি মাছের খাবার ভালো মানের হবে। এভাবে সাড়ে তিন মাস থেকে ৪ মাসেই বাজারজাত করা যায় মলা ঢেলা মাছ।