ঢাকার যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে অন্তত ১৫টি ‘রেডিয়াল রোড’ নির্মাণের চিন্তা করছে সরকার। বৃত্তাকার দুটি সড়ক অবকাঠামোর (রিং রোড) পাশাপাশি রেডিয়াল রোডগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। এতে ঢাকা শহরের বহুমুখী সড়ক যোগাযোগ সৃষ্টি হবে। বৃত্তাকার সড়ক থেকে শহরের ভেতর সংযোগের জন্য রেডিয়াল রোড ব্যবহৃত হবে।
এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা গেলে শহরের ট্রাফিকগুলো ভাগ হয়ে যাবে। শহরের যানজট কমবে, চলাচল নির্বিঘ্ন হবে। এভাবে বিষয়ভিত্তিক সমস্যাগুলো ধাপে ধাপে সমাধানের মাধ্যমে ঢাকার উন্নয়ন করা সম্ভব। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার সড়ক অবকাঠামোগুলো বিজ্ঞানভিত্তিক নির্মাণ করা হয়নি। ঢাকার বর্তমান সড়ক অবকাঠামোগুলো পর্যালোচনা করলে বিশৃঙ্খল চিত্র দেখা যায়। এ অবস্থায় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে তেমন সাফল্য মিলছে না।
তারা বলছেন, ঢাকা শহরের টেকসই ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা করতে দুটি রিং রোড (ইনার এবং আউটার) বাস্তবায়ন করা খুবই জরুরি। এখন কাজটি করলে খরচ যা হবে, দেরি করলে ব্যয় তার চেয়ে বেশি হবে। একই সঙ্গে শহরের পরিসর আউটার রিং রোড পর্যন্ত যাতে বিস্তৃত হতে না পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। ঢাকা শহর ওই পর্যন্ত বিস্তৃত হলে এসব রিং রোডেও সুফল মিলবে না। তখন আরও অনেক রিং রোড করতে হবে। এভাবে তো একটি শহর ব্যবস্থাপনা করা যায় না।
জানা যায়, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রণয়নাধীন খসড়া ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) দুটি রিং রোড এবং অন্তত ১৫টি রেডিয়াল রোডের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০১৬ থেকে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত মেয়াদের জন্য প্রণীত এ পরিকল্পনাটি শিগগিরই গেজেট আকারে প্রকাশ করা হতে পারে। প্রস্তাবিত রেডিয়াল রোডের মধ্যে রয়েছে আফতাবনগরের জহিরুল ইসলাম সিটি সড়ক, পুরাতন ডেমরা রোড, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, আশকোনা রোড, উত্তরা পূর্বের শাহকবির মাজার রোড, খিলক্ষেত ডুমনি রোড, দিয়াবাড়ি সড়ক, আব্দুল্লাহপুর ময়নার টেক সড়ক, ঢাকা-আশুলিয়া সড়ক, বিরুলিয়া সড়ক, বছিলা-আটিবাজার রোড, ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক, পূর্বাচলের ৩০ ফুট সড়ক এবং মাদানী এভিনিউ সড়ক। এসব রেডিয়াল সড়কের কোনোটি একটি এবং কোনোটি দুটি রিং রোডকে সংযোগ করবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক এবং গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সামসুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা সড়কের সড়কবিজ্ঞান বহির্ভূতভাবে নির্মিত হয়েছে। ব্যাকরণের ফরম্যাটে ঢাকার সড়কগুলো ফেলে বিশ্লেষণ করলে বিশৃঙ্খল চিত্র বেরিয়ে আসে। এ শহরের সড়ক অবকাঠামোয় শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে দুটি রিং রোড (ইনার এবং আউটার) বাস্তবায়ন করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। এটা আরও আগে বাস্তবায়ন করা দরকার ছিল। এটা এখনই করা গেলে ভালো। নাহলে যত দেরি হবে, বাস্তবায়ন ব্যয় এবং চ্যালেঞ্জ তত বাড়বে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাজউকের আরও আগে উচিত ছিল রেডিয়াল এবং রিং রোডের প্রস্তাব করা। কিন্তু এতদিন তারা সেসব করেনি। এজন্য যেসব এলাকায় উন্নয়ন হয়েছে, সেসব জমি অধিগ্রহণ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন। তারপরও শহরের স্বার্থে এসব করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক পেশাদারিত্ব দেখাতে হবে। রাজউক সেটা কতটুকু পারবে। প্রয়োজনে রিডেভেলপ করে এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, ‘রেডিয়াল রোডগুলো শহরের কেন্দ্রের সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ সৃষ্টি করে। ঢাকার বৃত্তাকার সড়কের সঙ্গে রেডিয়াল সড়কগুলো কার্যকরভাবে নির্মাণ করা সম্ভব হলে ট্রাফিক ব্যবস্থার অনেক উন্নয়ন ঘটবে। তবে রেডিয়াল সড়কগুলো দখলমুক্ত রাখা না গেলে কাক্সিক্ষত সুফল মিলবে না। এজন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।’
একই বিষয়ে নগরপরিকল্পনাবিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, ‘রেডিয়াল রোডে ট্রাফিকগুলো ভাগ হবে। এটা শহরের সঙ্গে বাইরের সড়কের সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি করবে। তবে সম্প্রসারণ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে রেডিয়াল রোড বা রিং রোড করে শহরকে গতিশীল রাখা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, ‘রেডিয়াল রোডগুলো কমপক্ষে চার লেন হওয়া উচিত। পাশাপাশি সার্ভিস লেন রাখতে হবে। আর প্রশস্ততা ১০০ ফুটের কম হবে না। ঢাকা শহরের বর্তমান বাস্তবতায় দুটি রিং রোড এবং ১৫টি রেডিয়াল রোড বাস্তবায়ন করে এ শহরকে বাসযোগ্য করা সম্ভব হবে।’
জানতে চাইলে রাজউকের নগরপরিকল্পনাবিদ এবং ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘ড্যাপ একটি সমন্বিত নগরপরিকল্পনা। সব সংস্থার পরিকল্পনা এখানে সংযুক্ত করা হচ্ছে। রাজউক সেগুলোর পরিকল্পনার দৃষ্টিতে কেমন হওয়া উচিত, এ ব্যাপারে বাস্তবায়নের সুপারিশ করছে।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা করতে দুটি রিং রোডের সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কার্যক্রম চলছে। আর এ রিং রোডের সুবিধা কাজে লাগাতে হলে রেডিয়াল রোড প্রয়োজন। রাজউক খসড়া ড্যাপে অন্তত ১৫টি রেডিয়াল রোড করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বহুলাংশে উন্নতি ঘটবে।’