চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃ চার দিনের সফরে ভারতের উদ্দেশে বৃহস্পতিবার ঢাকা ছেড়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার ভারত সফরে তিস্তার পানিবণ্টন ইস্যু প্রাধান্য পাবে।
তিস্তার পানি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সদিচ্ছা রয়েছে বলে মনে করে বাংলাদেশ।
কিন্তু পুরো বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ওপর ন্যাস্ত।
মমতা রাজি না হলে ক্ষরা মৌসুমে ভারত হয়ে বাংলাদেশে পানি ঢুকবে না। এটাই দেখা গেছে বারবার।
কেননা প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসেই বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে আন্তরিকতা দেখিয়েছিল মোদি সরকার।
কিন্তু ভারতের আইন অনুযায়ী, সুনির্দিষ্ট রাজ্যের অনুমোদন না পেলে কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নিলেও তা কার্যত হয় না।
যে কারণে তিস্তা-ফারাক্কা বিষয়ে বাংলাদেশ বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে।
তবে এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে বেশ আশাবাদী বাংলাদেশ।
কূটণৈতিকরা মনে করছেন, দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি তথা মোদি সরকারের অবস্থান পূর্বের সব সময়ের তুলনায় শক্তিশালী। মমতা ব্যানার্জি আগের চেয়ে দুর্বল বলে মনে করা হচ্ছে। যে কারণে তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তির সম্ভাবনা দেখছে বাংলাদেশ।
তবে বাংলাদেশ যাই ভাবুক তিস্তা চুক্তির বিষয়ে কী ভাবছেন ভারতের মানবাধিকারকর্মী, সমাজসেবী, লেখক, বুদ্ধিজীবী মহল।
এ বিষয়ে জার্মানির গণমাধ্যম ডয়েচ ভেলে কয়েকজন ভারতীয় মানবাধিকারকর্মী, সমাজসেবী, লেখক, বুদ্ধিজীবীর মতামত ও বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে।
গণমাধ্যমটি জানায়, পানিবণ্টন নিয়ে তাদের অনেকে মমতার পক্ষে মত দিয়েছেন। অনেকে আবার ভারতের মতো বাংলাদেশেরও তিস্তার পানি পাওয়ার অধিকার আছে বলে মনে করছেন। কে কেউ মনে করছেন তিস্তা চুক্তিকে ইগোর লড়াই হিসেবে নিয়েছেন মমতা।
এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাবেক প্রশাসনিক কর্তা মলয় হালদার বলেন, নদীর গতিপথ যখন প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হতো, তখন কোনো দেশের একক সিদ্ধান্ত কার্যকর করা সহজ হতো না। এখন ভাটির দেশকে নির্ভর করতে হয় উজান দেশের মনোভাবের ওপর। তিস্তার পানি যেমন ভারতের, তেমনি বাংলাদেশেরও। শুধু উত্তরবঙ্গের কথা বলে আন্তর্জাতিক বন্ধুত্বকে বলি দেয়া সমীচীন নয়।
তিস্তা চুক্তিতে মমতা ব্যানার্জির অবস্থানকে সাধুবাদের যোগ্য বলে মনে করেন কবি ও সমাজসেবী সুস্মিতা সর্বাধিকারী।
তিনি বলেন, ভারতের যে যে রাজ্যের ওপর দিয়ে তিস্তা নদী প্রবাহিত হচ্ছে, বাংলাদেশের সঙ্গে পানিবণ্টন চুক্তিতে সেই রাজ্যগুলোর স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে আন্তর্জাতিক স্তরে চুক্তিবদ্ধ হওয়া আবশ্যক। তা না হলে অন্যান্য পানিবণ্টন চুক্তির ক্ষেত্রে ভারত যে শিক্ষা পেয়েছে, এক্ষেত্রেও তা-ই হবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির অবস্থান সাধুবাদের যোগ্য।
তবে একেবারেই ভিন্ন মতা দিলেন পশ্চিমবঙ্গের সমাজসেবী অসীম দাস।
নদীর পানি আটকে রাখার চেষ্টাকে নিজের অধিকারের এখতিয়ার বলে মনে করা নেহাৎ মুর্খমি বলে মনে করেন এই সমাজসেবী।
তিনি বলেন, ভারত বা বাংলাদেশ উভয়েই কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিকাজ না হলে দুর্ভিক্ষ নেমে আসবে। বাংলাদেশকে তিস্তার পানি না দিয়ে ভারত যদি শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ দেখে, তাহলে ভবিষ্যতে নেপাল যদি ভারতকে ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি দিতে অস্বীকার করে, কী হবে তখন?
বিষয়টিকে একেবারেই মানবিক দৃষ্টিতে দেখছেন ভারতের একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী পাপন মালাকার।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে একটা আত্মার টান অনুভব করি। আমরা পানি অপচয় করব আর প্রতিবেশী দেশের ভাই-বোনেরা পানির অভাবে কষ্ট পাবে, এটা মন থেকে মেনে নিতে পারি না। তবে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যে যুক্তি দেখিয়েছেন তা নিয়েও আলোচনা প্রয়োজন।
দুই দেশের মধ্যে সমবন্টনের নীতি গ্রহণ করা উচিত বলে নিজের মত ব্যক্ত করেন সরকারি চাকরিজীবী কমলিকা ভট্টাচার্য।
তিনি বলছেন, তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এই ধরনের নদীতে কোনো একটি দেশ বা রাজ্যের একচ্ছত্র অধিকার থাকে না। সিকিম থেকে গজলডোবা পর্যন্ত তিস্তার ওপর বেশ কয়েকটি বাঁধ নির্মাণের কারণে বাংলাদেশের রংপুর-রাজশাহী অঞ্চল মরুর চেহারা নিচ্ছে। সেক্ষেত্রে নদী বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে প্রতি বছর এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শুকনো মৌসুমে দুই দেশের মধ্যে সমবন্টনের নীতি গ্রহণ করা উচিত।
একটি প্রকাশনী সংস্থার কর্মী অভিজিৎ চ্যাটার্জি এসব মানবিক দৃষ্টি ও আর্ন্তজাতিক আইনের ধার ধারেন না।
যে বিষয়ে শুধু ভারত লাভবান সেটাই করা উচিত বলে মনে করেন এই ব্যক্তি।
তিনি বলেন, তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি হোক বা না হোক, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে নিজের রাজ্যে রাজনীতি করতেই হবে। তাই তাকে রাজ্যবাসীর স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে কাজ করতে হয়। নদীর পানিতে কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ না রেখে উত্তরবঙ্গকে বঞ্চিত করে বাংলাদেশকে পানি দেয়ার মধ্যে কোনো মহত্ব নেই। সবার আগে রাজ্যবাসীর দিকে তাকানো উচিত।
কলকাতার একটি সনামধন্য কলেজের শিক্ষক মানবেন্দু সরকার বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আসছেন। তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা করে প্রাথমিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর এটাই উপযুক্ত সময়। হাসিনা চাইছেন, নরেন্দ্র মোদি চাইছেন। সিকিমের মুখ্যমন্ত্রীও চাইছেন। বেঁকে বসেছেন মমতা ব্যানার্জি। এটা সৌহার্দ্যের ছবি নয়। ভুল বার্তা যাচ্ছে।
বিষয়টি মমতা ব্যানার্জির ওপরই ছেড়ে দিলেন কলকাতার সেই কলেজের শিক্ষার্থী রাখী বিশ্বাস।
তিনি বলেন, দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তাচুক্তি নিয়ে আলোচনা চললেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। ফলে তিস্তার পানির দিকে তাকিয়ে আছে বাংলাদেশ। মমতা ব্যানার্জিকেই ঠিক করতে হবে, উনি রাজনীতি করবেন, নাকি দেশের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়াবেন।
বনশ্রী কোনার নামে এক নারী বলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন, তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ‘ইগো’ নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনটা কখনওই কাম্য নয়। দেশ তথা সার্বিক স্বার্থকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত।
প্রসঙ্গত ১৯৮৭ সালের পর থেকে একতরফাভাবে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত। ফলে প্রতি বছরের নির্দিষ্ট সময় বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকায় পানি সংকট চলছে। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ফসলি জমি। জীবন হচ্ছে বিপন্ন।
বিষয়টি নিয়ে বারবার তাগাদা দেয়ার পরও বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারত থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। যদিও ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিসহ ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে তিস্তা পানি চুক্তি সই করতে আসবেন বলে জানা গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসেননি তারা। তিস্তা চুক্তিও হয়নি আর। এরপর ২০১৫ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন মমতা। তবে ঢাকায় বসেই তিনি তিস্তার পানি দেয়া যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন।
সূত্র: ডয়েচে ভেলে