পদ্মা সেতু বিশ্বের ১১তম দীর্ঘ সেতু। এশিয়ার দ্বিতীয় দীর্ঘতম সেতু এটি। দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার ও ২১.৫ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট সেতুটি দেশের সর্ববৃহৎ ও বিশ্বে ১২২তম। সেতুর উপরে চলবে গাড়ি, নিচে চলবে রেল। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ যুক্ত হবে ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে ও রেলওয়ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল।
সারা বাংলাদেশের মানুষের বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু আগামী ২৫ জুন শুভ উদ্বোধনের উৎসব হতে যাচ্ছে। এ উৎসব বাংলাদেশের প্রত্যেক জেলায় হবে। অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাঙ্খিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করবেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার ফলে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ টি জেলার সােেথ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পৃথিবীর অন্যতম খরস্রোতা পদ্মা নদীর জন্য দীর্ঘ ৮ থেকে ১০ ঘন্টার পথযাত্রা শেষ হবে এবং দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য সূচিত হবে একটি নতুন অধ্যায়।
এডিপির হিসাব মতে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দেশের মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ মানুষ বসবাস করে। দীর্ঘদিনের অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৩ কোটি মানুষের সাথে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বন্ধন হবে সুদৃঢ়। মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হবে। বিশ্বব্যাংকের মতে, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর সুফল ভোগ করবে। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ ভারত, ভুটান, নেপাল ও মায়ানমারের সঙ্গে এ দেশের সড়ক ও রেল সংযোগ স্থাপিত হবে। ফলে এ অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ভূমিকার ফলেই আজ পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপ লাভ করেছে। নিচতলায় রেললাইন স্থাপনের কাজ চলছে। শুরুতে সেতুটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। এখন তা বাস্তবায়নে লেগেছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত আছে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের খরচ ১১ হাজার কোটি টাকা। তাছাড়া রয়েছে রেললাইন নির্মাণের খরচ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। সব মিলে মোট খরচ হবে ৮০ হাজার কোটি টাকার কিছু উপরে। এ পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশের এখনকার এক বছরের মোট বাজেটের মাত্র ১২ শতাংশ। এর বিপরীতে দেশের মানুষের যে উপকার হবে তা সীমাহীন। এতে পরিবহন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়বে। মানুষের চলাচল বৃদ্ধি পাবে। পণ্য পরিবহন সহজ হবে। মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হবে। কৃষিখাতে উৎপাদন বাড়বে। কৃষির বিভিন্ন উপখাতে আসবে ব্যাপক পরিবর্তন।
পদ্মা বহুমুখী সেতুতে থাকবে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ইন্টারনেট সংযোগ। সেতুটি স্টিল ও কংক্রিটের তৈরি হওয়ায় ঝুঁকি আছে বিধায় হাই ভোল্টেজ বিদ্যুৎ লাইন ৪০০ কেভি লাইন সেতুর পাশ দিয়ে আলাদাভাবে যাবে। তবে গ্যাস রেল লাইনের পাশ দিয়ে ও অপটিক্যাল ফাইবার সেতু দিয়েই যাবে। পানিপ্রবাহের বিবেচনায় বিশ্বে আমাজন নদীর পরই এর অবস্থান খরস্রোতা পদ্মা নদীতে নির্মিত হয়েছে পদ্মা সেতু। মাটির ১২০ থেকে ১২৭ মিটার গভীরে গিয়ে পাইল বসানো হয়েছে এই সেতুতে। পৃথিবীর অন্য কোনো সেতু তৈরিতে এত গভীরে গিয়ে পাইল প্রবেশ করাতে হয়নি, যা পৃথিবীতে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয় রেকর্ড হলো ভূমিকম্পের বিয়ারিং সংক্রান্ত। এই সেতুতে ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’র সক্ষমতা ১০ হাজার টন। এখন পর্যন্ত কোনো সেতুতে এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকার মতো করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এর পরের বিশ্বরেকর্ড হলো পিলার এবং স্প্যানের মধ্যে যে বিয়ারিং থাকে সেটি। এখানে ১০ হাজার ৫শ মেট্রিক টন ওজনের একেকটি বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। পৃথিবীতে এর আগে কোনো সেতুতে এমন বড় বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়নি। অন্য রেকর্ডটি হলো নদীশাসন সংক্রান্ত। ১৪ কিলোমিটার (১ দশমিক ৬ কিলোমিটার মাওয়া প্রান্তে ও ১২ দশমিক ৪ কিলোমিটার জাজিরা প্রান্তে) এলাকা নদীশাসনের আওতায় আনা হয়েছে। এটাও রেকর্ড।
পদ্মা সেতু শুধু সেতু নয়। নদীশাসন, মূল সেতু, পুনর্বাসন ও অ্যাপ্রোচ সড়কের কাজ করতে হয়েছে। বিদ্যুৎ লাইন ও গ্যাস লাইনও আছে। মূল সেতুর ব্যয় কিন্তু ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদ্যুৎ লাইন প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা । গ্যাস লাইন ৩০০ কোটি টাকার উপরে । শুধু ব্রিজে ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা খরচ হয়েেেছ। এটা কিন্তু রেলসেতুসহ দুইটা সেতু। মেঘনা সেতু একটা, ভৈরব সেতু একটা। পদ্মা কিন্তু দুইটা সেতু। এটা ছয় লেনের সেতু। ট্রেন কিন্তু যাবে ১৬০ কিলোমিটার গতিতে। এতো হাইস্পিড ট্রেন যাবে। এটা ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়ের একটা অংশ। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে হেভি লোডেড সেতু বানানো হয়েছে যা অনেক মালামাল নিয়ে যাবে এবং এই সেতু সিঙ্গাপুর থেকে যখন ইউরোপে ট্রেন যাবে তখন পদ্মা সেতু হয়ে যাবে। আগামী ১০০ বছরেও এইরকম সেতু আর হবে না তাই সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
পদ্মা সেতু চালু হলে শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনই নয়, বৈচিত্র্য আসবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহন ব্যয়সহ বিভিন্ন খাতে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে একদিকে যেমন দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি যোগসূত্র তৈরি হবে, ঠিক তেমনি এই সেতু ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। তবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পদ্মা সেতুর কারণে সবচেয়ে বেশি সুবিধা হবে কৃষিজাত পণ্যের বাজারজাতকরণে পরিবহনের ক্ষেত্রে। সেতুর কারণে কৃষক তার পণ্যের সঠিক মূল্য পাবেন।
পদ্মা সেতু চালুর পর খুলনাঞ্চলের ব্যবসায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। এর মধ্যে অন্যতম কৃষিতে পরিবর্তন। এ অঞ্চলের কৃষকরা প্রচুর ফসল উৎপাদন করতে পারলেও পর্যাপ্ত দাম পান না। এর মূল কারণ হলো, রাজধানীর সঙ্গে যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না হওয়া। তাই পদ্মা সেতু চালু হলে যাতায়াতের আর সমস্যা থাকবে না। এতে কৃষিপণ্যের বিপণন ব্যবস্থা সহজ হবে, এর সঙ্গে জড়িতরাও লাভবান হবেন।
কৃষিসম্পদ
দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে বলা হয় খাদ্যভান্ডার। কিন্তু এই সুযোগ এতদিন পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের ফলে সেখানে সবুজ বিপ্লব ত্বরান্বিত হবে। ধানের ঘাত সহিঞ্চু ও উচ্চ ফলনশীল নতুন জাতসমূহের বিস্তার ঘটবে। ফলে, চাল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। বরিশাল ও পটুয়াখালীতে তরমুজের চাষ হয়। কিন্তু ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এবং রক্ষণাবেক্ষণের অসুবিধাসহ বিপণন সমস্যার কারণে কৃষক তরমুজ চাষে তেমন লাভবান হন না। এখন এ সমস্যা দূর হবে এবং ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্রুত তরমুজ প্রেরণ করা সম্ভব হবে। তাতে কৃষকদের তরমুজ বিক্রি করে ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিশ্চিত হবে। দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ চরে নারিকেল ও সুপারির চাষ হয়। সমতলে হয় পান ও তেজপাতার চাষ। পটুয়াখালীতে মুগ ডালের চাষ হয় বাণিজ্যিকভাবে। জাপানসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে তা রফতানি করা হয়। প্রচুর ফুলের চাষ হয় যশোরে। এখানকার ফুল রফতানি হয় বিদেশেও। পদ্মা সেতুর ফলে এসব কৃষিপণ্যের চাষ উৎসাহিত হবে ব্যাপকভাবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট থেকে প্রতিদিন প্রায় ৬০০ টন কৃষিপণ্য রাজধানীতে নেয়া হয়।
প্রাণিসম্পদ
প্রাণিসম্পদ খাতে পদ্মা সেতুর প্রভাব হবে ইতিবাচক। সেতুটি চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দুগ্ধ ও মাংস শিল্প বিকশিত হবে। গরু মোটাতাজাকরণ কর্মসূচী দ্রুত এগিয়ে যাবে। অনেক দুগ্ধ খামার গড়ে উঠবে। মাদারীপুরের টেকেরহাট এখন দুগ্ধ উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। এর পরিধি শরীয়তপুর, ফরিদপুর এবং গোপালগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। তাছাড়াও পোল্ট্রি শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। দানাদার খাদ্য সহজে পরিবহন করার কারণে এর মূল্য হ্রাস পাবে। খামারিরা প্রাণি-পাখি প্রতিপালনে আগ্রহী হবে। দুধ ও মাংস প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের বিকাশ ঘটবে। তাতে বৃদ্ধি পাবে খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষের কর্মসংস্থান। পরিবহন খরচ কমাতে মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও ফরিদপুরের অধিকাংশ পশু ব্যবসায়ী ট্রলারে পশু নিয়ে রাজধানীতে আসেন। অন্যদিকে যশোর, মাগুরা, সাতক্ষীরা, নড়াইল ও ঝিনাইদহের ব্যবসায়ীরাও ট্রাকে করে গবাদিপশু ঢাকায় আনেন। পদ্মা পার হতে এসব ট্রাকের জন্য এতদিন ফেরিই ছিল ভরসা। বিড়ম্বনার সঙ্গে যুক্ত হতো বাড়তি খরচ। আবার ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে থাকতেন, অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডায় পশু আবার অসুস্থ হয়ে না যায়। অনেক সময় ফেরিঘাটে অসুস্থ গরু জবাই করে কম দামে মাংস বিক্রির নজিরও রয়েছে। ঢাকায় গরু নিয়ে যেতে ঘাটে অপেক্ষা করছিলেন যশোর থেকে পশু বিক্রি করতে আসা খামারিরা। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ফেরিঘাটের বিড়ম্বনা কমবে। আগে একটি ট্রাকে ২০টি গরু আনতে খরচ হতো ১৪-১৮ হাজার টাকা। এখন হয় ২২-২৫ হাজার টাকা। পদ্মা সেতু চালু হলে কম দামে ট্রাক পাওয়া যাবে কারণ ঘাটে ঘণ্টার পরে ঘণ্টা তখন অপেক্ষা করতে হবে না। এ বছর পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রাক পার হবে বলে খুব একটা টেনশনে নেই গরু ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা এক দিকে লাভবান হবে অন্যদিকে গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগী পালনে তরুণ উদোক্তারাও ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনায় এগিয়ে আসবে। দেশী বিদেশী অভিজ্ঞজনদের যাতায়তের ফলে এ অঞ্চলের মানুষজন জ্ঞানে ও গুণে সমৃদ্ধ হবে।
মৎস্যসম্পদ
খুলনা অঞ্চলের মাছ রাজধানীবাসীর পাশাপাশি রসনা বিলাসে ব্যয় হয় দেশের বাইরেও মানুষের। এই চাষে জড়িতরাও আছেন সেতু চালুর অপেক্ষায়। দেশের দক্ষিণাঞ্চল মৎস্য চাষ ও আহরণের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। চিংড়ি ও সামুদ্রিক মাছের সরবরাহ আসে মূলত দক্ষিণাঞ্চল থেকে। সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে আছে অসংখ্য মাছের ঘের। সেখানে গড়ে উঠেছে অনেক প্রক্রিয়াকরণ শিল্প। তাতে কাজ করছে অসংখ্য গরিব মানুষ। পদ্মা সেতুর ফলে নিবিড় মৎস্য চাষ উৎসাহিত হবে। রেণু পোনাসহ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
মাছ পরিবহনে সময় একটি বড় বিষয়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বা অন্য কোনো কারণে ফেরিঘাটে বেশি সময় ব্যয় হলে বরফ গলে গিয়ে যে সংকট দেখা দেয়, সেটি দূর হলেই চাষি ও ব্যবসায়ীদের আর্থিক ক্ষতি অনেকটাই দূর হবে। রাজধানীতে চিংড়ি পাঠাতে পদ্মায় ফেরির যানজটের কারণে অনেক সময় দুই দিনও দেরি হয়। তখন চিংড়িতে দেয়া বরফ ফুরিয়ে যায়। এতে চিংড়িতে ব্যাকটেরিয়া জন্মে। কিন্তু সেতু চালু হলে এই সমস্যা আর থাকবে না। সকালে পাঠানো চিংড়ি বিকেলে রাজধানীতে বিক্রি করতে পারবে। প্রতি বছর দেশ থেকে ৩০ হাজার টন চিংড়ি রপ্তানি হয়। এসব চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কারখানা খুলনা ও চট্টগ্রামে। অনেক সময়ে খুলনা থেকে চট্টগ্রামে চিংড়ি আনা-নেয়া করতে হয়। তখন ফেরিঘাটে অনেক কালক্ষেপণ হয়ে পণ্য নষ্ট হয়ে যায়।
দক্ষিণাঞ্চলেই প্রচুর মাছ উৎপাদিত হয়। বরিশালের ইলিশ, সুন্দরবনের নানা প্রজাতির মাছ ও বঙ্গোপসাগরেও আহরণ করা মাছ খুলনায় আসে। এখান থেকে মাছে নির্দিষ্ট পরিমাণ বরফ দিয়ে ট্রাকে করে ঢাকা নেয়া হয়। এক দিনের মধ্যে মাছগুলো ঢাকা পৌঁছাতে না পারলে ভালো বাজারদর পাওয়া যায় না। অনেক সময়ে ফেরিতে গাড়ি ওঠাতে ৩ থেকে ৬ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। ওই দিন ঢাকার বাজারে মাছ বিক্রি করতে পারেনা। পরের দিন বিক্রি করতে হয়। এতে পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। সেতু চালু হলে এ সমস্যা থাকবে না।
মৎস্য অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের তথ্য বলছে, প্রতিদিন খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট থেকে রাজধানীতে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ১৪৫ থেকে ১৬০ টন মাছ নেয়া হয়। এসব মাছের বাজারমূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা। মাছ জরুরি খাদ্যপণ্য। নির্দিষ্ট সময় পর এটি নষ্ট হয়ে যায়। পদ্মা সেতু চালু হলে মাছের বিপণন ও বাজারজাতকরণ সহজ হবে। এতে জেলে, মৎস্য চাষি ও ব্যবসায়ীরা বেশি লাভবান হবেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ও বিদেশে মৎস্য প্রেরণ সহজ ও ঝুঁকিমুক্ত হবে। তাতে মাছের অপচয় হ্রাস পাবে। তাছাড়াও সুনীল অর্থনীতি হবে গতিশীল। সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক আয় বৃদ্ধি পাবে মৎস্য খাত থেকে।
পাট
খুলনা থেকে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকার পাট রপ্তানি করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাট কিনে খুলনায় নিয়ে আসা হয়। এই পাট মোংলা বন্দর হয়ে বিদেশে রপ্তানি করা হয়। পাট কিনে আনার সময় পদ্মা নদী পাড়ি দিতে হয়। আবার খুলনার পাটকলে উৎপাদিত পাটজাত পণ্য রাজধানীতে নেয়া হয়। এতে যে সময়ের অপচয় হয়, তার আর্থিক মূল্য অনেক বেশি বিশ্ববাজারে পাটের অবস্থান ভালো করতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। পদ্মা সেতু চালুর পর এ খাত আরও এগিয়ে যাবে।
পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুুষের কাজের ক্ষেত্র অনেক সম্প্রাসারিত হবে। কৃষি বহুধাকরণ ও শস্যের বৈচিত্র্যকরণ সহজ হবে। কৃষি ব্যবসায় মানুষের আগ্রহ বাড়বে। উপযুক্ত কাজ ও আয়ের অভাবে যারা নিজের এলাকা ছেড়ে ঢাকা বা অন্য কোন এলাকায় চলে গিয়েছিলেন, তারা নিজ ঘর-বাড়িতে ফিরে আসবেন। আত্ম-কর্মসংস্থানের সুযোগ নেবেন। তাদের উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি পাবে। দক্ষতা অর্জিত হবে। বিভিন্ন অর্থ উপার্জনের কাজে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। ইপিজেড, পাটকল, চালকল পুরো মাত্রায় বিকশিত হবে। মোংলা, পায়রা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। তাতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।
এছাড়াও কৃষির উন্নয়নের জন্য আছে নব্য প্রতিষ্ঠিত খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও যশোরে আছে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। সুন্দরবন ও সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটায় পর্যটন শিল্প বিকশিত হবে। উন্নত যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার ফলে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর আরও সচল হবে। বর্তমানে দেশের ৯০ শতাংশ বৈদেশিক বাণিজ্য চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। সেতুটি চালু হলে স্বল্প সময়ে বন্দর থেকে মালামাল খালাস হয়ে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য বড় বড় শহরে পৌঁছাবে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর বাড়তি চাপ অনেকখানি কমে আসবে। তা ছাড়া সাগরকন্যা কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন, ভরতভায়না, ষাটগম্বুজ মসজিদ, খানজাহান আলীর মাজার, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মাজার, মাওয়া ও জাজিরা পারের হোটেল-মোটেল-রিসোর্টসহ নতুন-পুরনো পর্যটনকেন্দ্রগুলো দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হবে। এ ক্ষেত্রে কুয়াকাটা ও সুন্দরবনসংলগ্ন ছোট ছোট দ্বীপগুলো মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়ার মতো পর্যটন-উপযোগী হয়ে গড়ে উঠতে পারে। এ ছাড়া পৃথিবীর চারটি উত্তর-দক্ষিণ রেখা এবং তিনটি পূর্ব-পশ্চিম রেখা ভৌগোলিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ১২টি জায়গায় ছেদ করেছে তার একটি পড়েছে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলায়। সহজ কথায় কর্কট ক্রান্তি এবং ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমার ছেদবিন্দুটি পড়েছে এখানে, যা সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। ঠিক সেখানেই বঙ্গবন্ধুর নামে মানমন্দির নির্মাণের প্রস্তাব উঠেছে। মানমন্দিরটি নির্মিত হলে এটি হয়ে উঠবে এ অঞ্চলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র। ফলে অভ্যন্তরীণ পর্যটকসহ সারাবিশ্ব থেকে মানুষ ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ স্থানটি দর্শন করতে আসবে। এ ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু অনুঘটকের ভূমিকা পালন করবে। ফলে, অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। এগিয়ে যাবে সারাদেশ।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের হিসাবে পদ্মা সেতুর ফলে দেশের জিডিপি ১.২৩% বাড়বে ও দক্ষিণাঞ্চলের বাড়বে ২.৩%। সারাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে যাবে ২.২ শতাংশে। প্রায় ১ শতাংশ দারিদ্র্যের হার হ্র্রাস পাবে। তাতে ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষ উন্নয়নের মূল ধারায় যুক্ত হবে। পদ্মা সেতু তাদের জীবন ধারায় আনবে ব্যাপক পরিবর্তন। পদ্মা সেতু আমাদের উন্নয়ন, বিজয়, গৌরব এবং ঘুরে দাঁড়ানো, হার না মানার, আত্মনির্ভরশীলতা ও সক্ষমতার প্রতীক। এত বড় একটি প্রকল্প নিজ অর্থায়নে সম্পন্ন করে বাংলাদেশ আর্থিক ও কারিগরি সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে বিশ্ববাসীর সামনে। এটি আমাদের ভাবমূর্তিকে সমুজ্জ্বল করেছে।
দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য পদ্মা সেতু কতটা জরুরি, ওই পথে চলাচলের অভিজ্ঞতা ছাড়া তা আসলে বোঝা খুবই কঠিন। শতশত মালবাহী ট্রাক থাকে অপেক্ষায়, কাঁচামাল তো ঘাটেই পঁচে যায়, এসব মোটামুটি নিয়মিত চিত্র। এরপর যদি নদীর স্রোতে ঘাট ভেঙে যায়, যন্ত্রণা তখন আরও বেড়ে যায়। সবচেয়ে বেদনাদায়ক ব্যাপার হয়, যখন কোনো মুমূর্ষু রোগী নদী পার হওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকে। প্রতিটি মিনিট তখন মনে হয় অনন্তকাল। ওই পরিবার তখন কতটা অসহায় থাকে, কেউ ওই অবস্থায় না পড়লে বোঝা দায়। ঘাটেই রোগী মারা গেছে, ঢাকায় এনে চিকিৎসা করানো যায়নি, এরকম নজির আছে অনেক। প্লেনে বা হেলিকপ্টারে রোগী আনার সামর্থ্য কজনেরই বা আছে! এছাড়াও আরও কত যে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, এই পথের নিয়মিত যাত্রীরাই কেবল বোঝে। সেই যন্ত্রণাময় দিনগুলি শেষ হতে চলেছে। অনেক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে, অনেক প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে পদ্মা সেতু এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। কোটি কোটি মানুষের কাছে এটা স্বপ্নের চেয়েও বড় কিছু। অনেকে কখনও কল্পনাও করতে পারেননি, জীবদ্দশায় পদ্মার ওপর সেতু দেখতে পাবেন। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ ইট-পাথরের তৈরি সেতু নয়, এই অঞ্চলের মানুষের কাছে এটা অনেক আবেগ-অনুভূতির প্রতিশব্দ। এর সঙ্গে কোটি মানুষের ভালোবাসা, আবেগ, গৌরব মিশে আছে। বাঙালি জাতি যেকোনও প্রতিকূল পরিবেশে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, এই সেতু তার প্রমাণ। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এসব সমস্যার সমাধান তো এখন হবেই, এই অঞ্চলে এখন শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে, বেকারত্ব দূরীকরণে তা ভূমিকা রাখবে, গোটা দক্ষিণাঞ্চলের চেহারা বদলে যাবে। পদ্মা সেতু দক্ষিণের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের একটা সিঁড়ি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্ম, বেড়ে উঠা এই দক্ষিণাঞ্চলে বলেই হয়ত এমন সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। পদ্মা সেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসের প্রতীক, বাঙালির শতবর্ষে সাহসিকতার প্রতীক হয়ে থাকবে এটি। জাতিকে প্রথমবারের মতো আর্থিক সামর্থ্যের পরিচয়ও বহন করে এই পদ্মা সেতু। ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আল্লাহ আপনাকে সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু দান করুন।
লেখক : কৃষিবিদ প্রফেসর ড. মোঃ শহীদুর রহমান খান, ভাইস-চ্যান্সেলর, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়