চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃপাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইভিনিং কোর্সের নামে নামমাত্র গ্র্যাজুয়েট তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইভিনিং মাস্টার্স ও ডিপ্লোমা প্রোগ্রামের নামে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দেয়া হচ্ছে ডিগ্রি। এর জন্য হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। কোন কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইভিনিং কোর্সে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও বেশি টাকা আদায় করা হয়।
নামমাত্র পরীক্ষা কিংবা কোনো পরীক্ষা ছাড়াই এসব কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের নকলের সুযোগ দেয়া হয় বলেও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। ক্লাস না করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণেরও অভিযোগ রয়েছে। এভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘বিকল্প পথে’ নামমাত্র গ্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে দেশে। যদিও সুবিধাভোগী বাদে বেশিরভাগ শিক্ষক এ কোর্সের বিপক্ষে।
এনিয়ে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনও করেছেন। তবুও কোন কাজ হচ্ছে না। অভিযোগ আছে, ইভিনিং মাস্টার্স কোর্সের ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশই নিয়মিত কোর্সে ভর্তির জন্য আবেদনেরই যোগ্যতা রাখেন না। কিন্তু এক শ্রেণির শিক্ষকের অর্থের লোভের কারণে এ ধরনের ছাত্রছাত্রীরাই বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বনে যাচ্ছেন।
ওই শ্রেণির শিক্ষকরা নিয়মিত কোর্সের ব্যাপারে উদাসীন। কেউ ক্লাস ফাঁকি দেন। আবার কেউ পরীক্ষার খাতা নিয়ে দিনের পর দিন ফেলে রাখেন। অথচ এ ধরনের শিক্ষকরাই ইভিনিং মাস্টার্স কোর্সে বেশি সক্রিয়। এতে শিক্ষকের ব্যক্তিগত অধ্যয়ন ও গবেষণাও হচ্ছে বিঘ্নিত। যার সার্বিক প্রভাব পড়ছে দেশের উচ্চশিক্ষার মানে।
সরকারের অর্থে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিনে ‘পাবলিক’ আর রাতে ‘প্রাইভেট’ চরিত্রে রূপান্তরের কারণে ক্ষুব্ধ সাধারণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইভিনিং মাস্টার্স প্রোগ্রাম নিয়ে খোদ চ্যান্সেলর ও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদও উদ্বিগ্ন। গত ৬ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তনে তিনি ডিপ্লোমা ও সান্ধ্যকালীন কোর্সের নামে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান কোর্স নিয়ে ভাবার জন্য সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানান। এর আগে ২০১৭ সালের ১৬ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির একটি প্রতিনিধি দল সাক্ষাতে গেলে রাষ্ট্রপতি তাদেরও ইভিনিং কোর্সের ব্যাপারে নিজের অবস্থানের কথা জানান।
অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনে ইভিনিং কোর্সের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, ডিপ্লোমা ও সান্ধ্যকালীন কোর্সের নামে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন বিষয়ে ডিগ্রি দেয়া হচ্ছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যের পাশাপাশি স্বাভাবিক লেখাপড়ার পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে কি না, ভাবতে হবে। আমি মনে করি, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ছাত্র-শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা ভেবে দেখবেন। মনে রাখতে হবে, জনগণের অর্থেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়। তাই তাদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই ইভিনিং কোর্স চালুর ব্যাপারে ইউজিসির কোনো অনুমোদন আছে বলে আমার জানা নেই। চ্যান্সেলর এ কোর্সের ব্যাপারে ভাবার আহ্বান জানিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে এখন ভাববার সময় হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
অভিযোগ আছে, ইভিনিং প্রোগ্রামের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর ক্যাম্পাস পরিণত হয় বাজারে। এ কোর্সে প্রাপ্ত অর্থের অপব্যবহার করে কোনো কোনো অনুষদের ডিন অনৈতিকতা চর্চা করেন বলেও অভিযোগ আছে। নানা কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিদের পক্ষ থেকেও ইভিনিং প্রোগ্রাম বাতিলের দাবি উঠেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ প্রফেসর ড. মো. কামালউদ্দিন ২০১৭ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশনে নিজের বক্তৃতায় ইভিনিং কোর্স নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, বাণিজ্যিকভাবে চালু হওয়া সান্ধ্যকালীন কোর্সে নিম্নমানের গ্র্যাজুয়েট তৈরির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাহানি ঘটছে। সর্বশেষ গত জুনে অনুষ্ঠিত সিনেট অধিবেশনেও সদস্যরা এই কোর্স নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। কিন্তু এত কিছুর পরও রহস্যজনক কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইভিনিং কোর্সের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
জানা গেছে, নানা মহল থেকে সমালোচনা আর চাপ সৃষ্টির পর ইভিনিং মাস্টার্স প্রোগ্রামের সার্বিক চিত্র তুলে আনতে সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত ওই কমিটিতে আরও চারজন ডিন সদস্য হিসেবে আছেন। যদিও কমিটির কাজ রহস্যজনক কারণে তেমন এগোচ্ছে না।