চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃপ্রধান শিক্ষক হরেকৃষ্ণ দাশ (ইনডেক্স নং- ২০৮৯৭৬)। স্নাতক থেকে স্নাতকোত্তর। দু’বছরের এই শিক্ষা জীবন পেরোতে যার সময় লেগেছিল ১৫ বছর। সালটা ৮৫ থেকে ৯২। কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দির স্কুল এন্ড কলেজের এই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে এবার যোগহল নানা অনিয়ম, হটকারিতা, স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির অভিযোগ। সম্প্রতি এক শিক্ষক প্রতিনিধির সাথে সাধারণ এক শিক্ষকের ফোনালাপ ফাঁস হওয়ায় প্রধান শিক্ষক হরেকৃষ্ণ দাশের নানা অনিয়মের বিষয়টি বেরিয়ে পড়ে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ইতিহাস প্রসিদ্ধ কপিলমুনিতে রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু ১৯২৬ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। আর এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে হরেকৃষ্ণ দাশের যোগদান করেন ২০০৪ সালের ১০ ফেব্র“য়ারি। আবার যোগদান নিয়েও ছিল নানা বিতর্ক। শুরু থেকে বিতর্ক যেন পিছু ছাড়েনি তার। ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানে ১৫ বছরের কর্মজীবনে এই শিক্ষকের অনৈতিক কর্মকান্ড প্রতিবাদ জানিয়ে তাকে অপসারনের দাবিতে ইতোপূর্বে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণীর পেশার মানুষ ও স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ গণস্বাক্ষর করে জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেছিল। তার নানা অনিয়মের খবর বিভিন্ন সময় খবরের শিরোনাম হয়েছে। সম্প্রতি এক ফোনালাপে নতুন করে নানা দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। চলতি বছরের ২৮ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রানালয়ের (নিরীক্ষা অসিঃ) যুগ্ম-পরিচালক টুটুল কুমার নাগ বিদ্যালয় পরিদর্শন ও নিরীক্ষা সংক্রান্ত কর্মশালা পরিচালনা করেন। অন্যদিকে বর্তমান প্রধান শিক্ষক তার এবং কয়েকজন শিক্ষকের নিয়োগ সংক্রান্ত ব্যক্তিগত ত্র“টিপূর্ণ কাগজপত্রের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে একটি এমপিও সমপরিমাণ (৪,৮৯,৩৪৪ টাকা) প্রায় ৫ লক্ষ টাকা খরচ হবে বলে দাবি করেন তিনি।
এ ব্যাপারে শিক্ষক প্রতিনিধি কার্ত্তিক চন্দ্র সরকার বলেন, প্রথম থেকেই অডিটের ব্যাপারে আমাদের কিছু কিছু ধোঁয়াশা মনে হচ্ছিল। সেকারণে আমি ও আমার একজন সহকর্মীকে সাথে নিয়ে অডিটের পূর্বে বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ও সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের সাথে দেখা করি। তিনি অডিটে আসা দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিকে তার (ডিসি সাহেবের) অফিসে ঘুরে যাওয়ার কথা বলেন। ডিসি সাহেবের পরামর্শ মোতাবেক আমরা অডিটে কোন টাকা দিতে আপত্তি জানাই। এতে প্রধান শিক্ষক পিড়াপিড়ি শুরু করেন। তবে প্রথমে একটি এমপিও’র কথা বললেও পরে ২ লক্ষ টাকা নিচে হাতে দিলে হবেনা এমনটি জানান তিনি। পরবর্তীতে লক্ষাধিক টাকা শিক্ষকদের কাছ থেকে তুলে রাখা হয়েছে স্বীকার করে বলেন, উনি (প্রধান শিক্ষক) ব্যক্তিগত অনেক নয়ছয় করেন। বলা যেতে পারে তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের ৮০ থেকে ৯০% সত্য। আমি একজন সদস্য হিসেবে মনে করি প্রতিষ্ঠানের আয় ব্যয়সহ সব কিছুর স্বচ্ছতা থাকা প্রয়োজন। এর আগে যারা ছিলেন তারা সবাই উনার জয়ধ্বনি করেছে। এনিয়ে শিক্ষদের মধ্যে চরম অসন্তোষ ছিল। আমি চাই উনার কর্মকান্ড অন্ধকারে না থেকে আলোর মধ্যে আসুক।
অপর একটি সূত্রের দাবি, নিরীক্ষা চলাকালীন সময়ে পরিচালনা পরিষদের সভাপতির সাথে শিক্ষা পরিদর্শক টুটুল কুমার নাগের মুঠো ফোনে সৌজন্যমূলক আলাপ হয়। এ ঘটনার পর প্রধান শিক্ষকের একটি এমপিও সমপরিমাণ অর্থ দাবির আওয়াজটা সংকুচিত হয়। যার ধারাবাহিকতায় ২ জন শিক্ষক ও কর্মচারী বাদে বাকি ২২ জন শিক্ষক ৫/৬ হাজার টাকা হারে ১ লক্ষ ১৬ হাজার টাকা প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে উত্তোলন করেন।
বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের একাধিক বর্তমান ও সাবেক সদস্য, অভিভাবক ও স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রধান শিক্ষক হরেকৃষ্ণ দাশ একজন অযোগ্য, উপঢৌকনবাজ। তার বিরুদ্ধে বিধি বহির্ভূত প্রজেক্ট বাস্তবায়ন, আবাসিক কোয়াটার নির্মাণে অতিরিক্ত ব্যয়, টেন্ডার ছাড়াই বিভিন্ন মেয়াদে কোটি কোটি টাকা বিপনী বিতান নির্মাণ, গেস্ট হাউজসহ ইচ্ছামাফিক অপরিকল্পিত সংস্কার কাজের নামে অর্থ আত্মসাৎ, হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর না করা, মুভমেন্ট রেজিস্ট্রার না মেনে পারিবারিক ও ঘের ব্যবসায় স্কুল চলাকালীন সময়ে অন্যত্র সময় ব্যয়, ভাউচারে কাউন্টারে স্বাক্ষর না করাসহ নানা অনিয়ম করেছেন।
স্থানীয়দের দাবি, বিদ্যালয় চত্বর জুড়ে গড়ে উঠা ৮৫টি দোকান ঘরের আয়ের হিসাব, দোকান ঘরের মালিকানা হস্তান্তরের আইনগত দিক খতিয়ে দেখা জরুরি।
প্রধান শিক্ষক হরেকৃষ্ণ দাশ নিয়োগকাল থেকে বিদ্যালয়ের কোয়াটারের থাকেন। অন্যদিকে সরকারি তহবিল থেকে নিয়মিত বাড়ি ভাড়া উত্তোলন করেন তিনি। এমপিও প্রাপ্তি থেকে খতিয়ে দেখলে সত্যতা মিলবে। প্রধান শিক্ষক নিজে ১৫ বছরে ১টিও ক্লাস নেননি, এমনকি ক্লাসের বাইরে শিক্ষকরা টিউশনিতে ব্যস্ত থাকলেও তিনি কোন ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে স্বজন প্রীতির অভিযোগ করেছেন অনেকে।
এদিকে কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দির স্কুল এন্ড কলেজ এমপিও (কলেজ পর্যায়) করাতে দাবিকৃত ৫ লক্ষ টাকার মধ্যে ২ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা স্থানীয় ব্যাংকের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষকের আস্থাভাজন টাঙ্গাইলের ফারুকের (পিয়ন ফারুক)-এর একাউন্টে কয়েক দফায় পাঠানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সম্প্রতি ঘোষিত এমপিও-এর তালিকায় স্কুল এন্ড কলেজ পর্যায়ে এই প্রতিষ্ঠানের নাম না থাকায় ক্ষোভে নাম প্রকাশ না করা শর্তে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একাধিক শিক্ষক কর্মচারী সাংবাদিককে এ তথ্য জানিয়েছেন।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির নেতা হিসেবে সরকারি নীতিমালার বাইরে নিম্নমানের গাইড বই বিক্রয়ে সুযোগ দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করেছে এমন অভিযোগ রয়েছে। এই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০১৮ এর ১১.৬ ধারার নিষেধাজ্ঞা লংঘন করে বয়স ৬০ (ষাট) বছর পূর্ণ হবার পরও শিক্ষক পুনঃনিয়োগ দিয়ে বিধিভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে।
বিভিন্ন সময় জেলা প্রশাসকের পরামর্শ এড়িয়ে শঠতার আশ্রয় নিয়ে ম্যানেজিং কমিটির সভায় সদস্যদের উপস্থিতির সূচক স্বাক্ষরকে সিদ্ধান্ত মূলক স্বাক্ষর হিসেবে চালিয়ে দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে এই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
অভিভাবক সদস্য কিনু পাল প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সত্যতা স্বীকার করে বলেন, তার অনৈতিক কোন কর্মকান্ডের দায় আমাদের নয়। আমি প্রধান শিক্ষকের অবসরে যাওয়ার পূর্বেই বিদ্যালয়ের সকল আয় ব্যয়সহ প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি ও সম্পদের যাবতীয় কাগজপত্র সরকারি ভাবে নিরপেক্ষ নিরীক্ষনের দাবি জানাচ্ছি।
স্থানীয়ভাবে দাবি উঠেছে, বিদ্যালয় চত্বরে এ যাবতকাল তৈরি সকল বিপনীর বর্তমান মালিক কারা, কাদের নামে প্রথম বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল, তার তালিকা প্রস্তুত করা, মালিকানা হস্তান্তরের আইনগত বৈধতা খতিয়ে দেখা এবং এগুলোর বৈষম্য মুক্ত ভাবে আয়ের হিসাব নিরীক্ষনের জন্য নিরপেক্ষ সরকারি ভাবে তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহন করা। প্রধান শিক্ষক যোগদানের পর থেকে বিদ্যামন্দিরের সকল আয় ও ব্যয় বিশেষ করে আপ্যায়ন খাতের ব্যয় বাৎসারিক সংস্কার ব্যয় বরাদ্দ সরকারিভাবে নিরীক্ষা করা। এছাড়া প্রধান শিক্ষকের নিজ হটকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনৈক অভিভাবক সদস্য শেখ আব্দুস ওয়াহিদ বাদী হয়ে হাইকোটের রীট পিটিশন (পিটিশন নং-৩২৪/২০১৪) টি মোকাবেলায় স্কুলের প্রায় ৬ লক্ষ টাকা খরচের বৈধতা যাচাই করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
প্রধান শিক্ষক হরেকৃষ্ণ দাশ বলেন, আমার যাওয়ার সময় হয়েছে। আমি কিছু বলতে চাই না। মন্ত্রণালয় অডিট প্রসঙ্গে বলেন,পরিদর্শনে আসা শিক্ষা পরিদর্শকদের টাকা দেয়া আমাদের দেশে নিয়মে পরিণত হয়েছে। টাকা দেয়া নাহলে রির্পোট ভালো দেয় না । আর টাকাতো আমি চাইনি টাকা চেয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের অধিন পরিদর্শণ ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর এর শিক্ষা পরিদর্শক টুটুল কুমার নাগ নিজে আমার স্কুলের শিক্ষক প্রতিনিধির সামনে একটি এমপিও সমপরিমান টাকা দাবি করেছেন। আমার নিয়োগপত্রে স্কুলের বাসভবন ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। সরকারি বাসাভাড়া গ্রহণ করতে বাধা নেই। তিনি বাড়ি ভাড়া বাবদ সরকারি বরাদ্দ গ্রহণের কথা স্বীকার করেন।