খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ ১৫ই আগস্ট (সোমবার) হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭তম শাহাদাৎ বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শোক দিবসের কর্মসূচির শুরুতে সকাল ৯টায় শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ প্রশাসন ভবনের সামনে কালোব্যাজ ধারণ, জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়।
সকাল ৯.১০ মিনিটে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের প্রাক্কালে উপাচার্যের নেতৃত্বে শোকর্যালি শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ প্রশাসন ভবনের সামনে থেকে শুরু হয়ে হাদী চত্ত্বর ঘরে মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে স্থাপিত কালজয়ী মুজিব চত্বরে গিয়ে শেষ হয়। পরে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে উপাচার্য প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন। এসময় উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. মোসাম্মাৎ হোসনে আরা, ডিনবৃন্দ, রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) উপস্থিত ছিলেন। এরপরপরই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল, বিভিন্ন স্কুল (অনুষদ), বিভিন্ন ডিসিপ্লিন (বিভাগ), বিভিন্ন হল, শিক্ষক সমিতি, অফিসার্স কল্যাণ পরিষদ ও বিভিন্ন সংগঠন এবং কর্মচারীবৃন্দের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হয়।
দিবসটি উপলক্ষ্যে সকাল ৯.৩০ মিনিটে ক্যাম্পাসে অদম্য বাংলার অদূরে খননকৃত নতুন পুকুরের পাড়ে সোনালু, বনসোনালু, ম্যানগ্রোভ লাল কাঁকড়া প্রজাতি এবং তালের চারা রোপণ করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে উপাচার্য এ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। পরে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য যৌথভাবে সোনালু গাছের চারা রোপণ করেন। এরপরে খানজাহান আলী হলেও একটি বকুলের চারা রোপণ করেন উপাচার্য।
এছাড়া বেলা ১১টায় আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু একাডেমিক ভবনের সাংবাদিক লিয়াকত আলী মিলনায়তনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য উপাচার্য প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিছকই একটি হত্যাকাণ্ড নয়; এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে একটি জাতিকে হত্যা করা হয়। বাঙালি জাতির আশা, আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নকে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ ছাপিয়ে বিশ্বে একটি সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু এই বিশ্ববন্ধু হওয়া অনেকেই পছন্দ করেননি। যার কারণে দেশ ছাপিয়ে বিদেশেও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অপপ্রচার শুরু হয়েছে। বঙ্গবন্ধু থেকে তাঁকে বন্ধুহীন করার অপ্রচেষ্টা করা হয়। জনপ্রিয় নেতা থেকে অপ্রিয় নেতায় পরিণত করার ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পূর্বে দেশে নানা রকম ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বাকশাল ও ব্যাংক সেক্টর নিয়ে নানা রকম প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়। যার অংশ হিসেবে গুপ্ত হত্যা করা হয়। ঈদের নামাজের মধ্যে এমপিকে হত্যা করা হয়।
উপাচার্য বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা গেলেও তাঁর চেতনাকে হত্যা করা সম্ভব হয়নি। আজও তার আদর্শ কোটি মানুষ হৃদয়ে ধারণ করে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু যেভাবে দেশের মানুষের জন্য ভেবেছেন, কাজ করেছেন; আমাদেরও সেভাবে দেশ ও মানুষের জন্য ভাবতে হবে, দেশের জন্য কাজ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনার প্রতিফলন ঘটিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু দেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার যে স্বপ্ন আমাদের দেখিয়েছেন; সেই স্বপ্ন পূরণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের কাজ করে যেতে হবে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু একটি অনুভূতির নাম। যা কখনোই মুছে ফেলা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর সাথে কারো তুলনা করাই চলে না।
সভা মুখ্য আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক, প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. মাহবুবুর রহমান। আলোচনাকালে তিনি ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এর সুদীর্ঘ ইতিহাস, ৭৫ এর পূর্ব ও পরবর্তী প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া বাংলাদেশ অচল। তিনি চিন্তা করেছেন স্বাধীন দেশ গড়বেন, দারিদ্র্যমুক্ত করবেন; তা তিনি করে দেখিয়েছেন। তিনি খোকা থেকে মুজিবুর, মুজিব ভাই, বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা পর্যন্ত উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। তিনি কর্মী থেকে নেতা হয়েছে। প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ইতিহাসের সাথে বঙ্গবন্ধুর নাম জড়িত। ভাষা আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দীও তিনি। চাইলেই কেউ তার নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু নামের ওপর মুকিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু না থাকলে ৯ মাসে স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হতো না। ৯ মাসের মধ্যে দেশের সংবিধান রচিত হতো না। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের কাজে অগ্রগতি হতো না। শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠতো না।
মুখ্য আলোচক বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্বে দেশে হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়। ধর্ম নিরপেক্ষা নিয়ে নানা ধরনের অপপ্রচার করা হয়। জাতীয় ঐক্যের জন্য তৈরি করা বাকশাল নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনিরা নিম্ন পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তা হওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে তারা ক্ষমতা গ্রহণ করেনি। খন্দকার মোশতাক স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিলে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও অন্যান্য মাধ্যম থেকে তাকে অপ্রত্যাশিতভাবে সমর্থন জানানো হয়। শুরু হয়ে যায় রাষ্ট্রীয় কাজে ধর্মের অপব্যবহার। পরবর্তীকে মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করে তারা ক্ষমতা গ্রহণ করেন। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করেই হা না ভোটের মাধ্যমে মসনদে বসেন। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর স্বাধীনতা বিরোধীদের পুনর্বাসিত করেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভুলুণ্ঠিত করেছেন।
তিনি আরও বলেন, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সেনাবাহিনী, পুলিশ, রাজনৈতিক ও ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলা, প্রতিবাদ না করা ছিলো দেশ ও জাতির জন্য সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত, প্রহসনমূলক। এটা মেনে নেওয়া যায় না। জাতি হিসেবে এখানেও আমাদের কলঙ্ক রয়েছে।
আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. মোসাম্মাৎ হোসনে আরা। সূচনা বক্তব্য রাখেন রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর খান গোলাম কুদ্দুস। সভাপতিত্ব করেন শোক দিবস উদযাপন কমিটির সভাপতি এবং কলা ও মানবিক স্কুলের ডিন প্রফেসর ড. রুবেল আনছার। আরও বক্তব্য রাখেন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. তরুণ কান্তি বোস ও অফিসার্স কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দীপক চন্দ্র মন্ডল।
আলোচনা সভার শুরুতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৫ আগস্ট রাতে নিহত শহিদদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব কর্মসূচিতে বিভিন্ন স্কুলের ডিন, ডিসিপ্লিন প্রধান, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীবৃন্দ এবং শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।
পরে সেখানে আইন ডিসিপ্লিন কর্তৃক প্রকাশিত স্মরণিকা ‘অগ্নিগিরির অস্তাচল’ এর ৫ম সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করেন উপাচার্য। এসময় উপ-উপাচার্য, মুখ্য আলোচক, আইন স্কুলের ডিন ও ডিসিপ্লিন প্রধান, স্মরণিকা প্রকাশনার সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। এরপর সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবনের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘হাসিনা: এ ডটার্স টেল’ প্রদর্শিত হয়। এছাড়া বাদ যোহর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে সকাল ৯.৫০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয় মন্দিরে প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়।
অপরদিকে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে প্রভোস্ট প্রফেসর ড. তানজিল সওগাতের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হয়। এছাড়া কোরআনখানি অনুষ্ঠিত এবং এতিমদের মাঝে খাবার বিতরণ করা হয়। অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- রাতে হলে ৫ মিনিট নিষ্প্রদীপকরণ কর্মসূচি পালন করা হবে।