চলমান বন্যায় জেলার ৫৩১ পুকুরের মাছ ভেসে যাওয়ায় মৎস্যচাষীদের ক্ষতির পরিমান এক কোটি ৯৮ লাখ টাকারও বেশি।
চাষীরা বলছেন, বন্যার আগ মুহূর্তে মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে যদি তাদের মাঝে সচেতনতামূলক প্রচারনা চালানো হতো তাহলে এই ক্ষতি রোধ করা সম্ভব হতো। যদিও জেলা মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বন্যার আগে তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে যথাযথ প্রচারণা চালিয়েছেন। তবে তারা বন্যা পরবর্তী ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার ব্যাপারে চাষিদের পরামর্শ দিচ্ছেন।
মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জেলায় মোট মৎস্যচাষীর সংখ্যা ২০ হাজার ৮৯৬ জন এবং পুকুরের সংখ্যা ২২ হাজার ২১৫টি। এবারের বন্যায় জেলায় ৪৩৩ জন মৎস্যচাষীর ৫৩১টি পুকুর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং পোনাসহ বিভিন্ন মাছ ভেসে গেছে। ক্ষতিগ্রস্থ পুকুরের জমির পরিমান প্রায় ৮০.৬৮ হেক্টর। ভেসে যাওয়া মাছের পরিমান ১০৭.৮৯ টন; যার আনুমানিক মূল্য এক কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এ ছাড়া ভেসে যাওয়া পোনার পরিমান ২৬.০৯০ লক্ষ টি, যার আনুমানিক মূল্য ১৮ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। মৎস্যচাষীদের মাছসহ পুকুরের ক্ষতির মোট পরিমান প্রায় এক কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
পুকুরে মাছ চাষের সময় নেটসহ বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া পুকুরের পাড় তৈরি করাসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত খরচ রয়েছে। বন্যার সময় নেট ছিড়ে যাওয়াসহ পুকুরের যে ক্ষতি হয় তা পুকুরের অবকাঠামোগত ক্ষতি হিসেবে ধরে মৎস্য বিভাগ।
সদর উপজেলার পাঁচগাছী ইউনিয়নের উত্তর নওয়াবশ গ্রামের কৃষক তাইজুল ইসলাম (৩৯) বলেন, এক একর পরিমান দুইটি পুকুরে ২৪ হাজার টাকার রেনু পোনা ছেড়েছিলাম। পুকুর পাড় ঢুবে গেলেও মাছ যেন বের হয়ে যেতে না পারে, সে জন্য নাইলন নেট দিয়ে পুকুর ঘিরে রেখেছিলাম। গত এক সপ্তাহ আগে ধরলা নদীর বন্যার পানিতে ভেসে আসা কচুরি পানার চাপে নেট ছিঁড়ে পানা পুকুরে ঢুকে পড়ে এবং মাছ বের হয়ে যায়। তবে কী পরিমান মাছ বের হয়ে গেছে, তা বুঝতে পারছি না।
”বন্যার আগে মৎস বিভাগের কেউ আমাদেরকে কিছুই বলে নি। আমার মৎস্য চাষের প্রশিক্ষণ থাকায় নেট দিয়ে মাছ বাঁচানোর চেষ্টা করেছি। যদিও মাছ রক্ষা করতে পারি নি। তবে প্রচার-প্রচারণা থাকলে অনেক চাষীই তাদের মাছ রক্ষা করতে পারত”, যোগ করেন তিনি।
সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের আরাজী কদমতলা গ্রামের মৎস্যচাষী সোহরাব আলী (৫০) বলেন, এক একর পরিমান পুকুরে প্রায় লক্ষাধিক টাকার পোনা মাছ ছেড়েছিলাম। গত এক সপ্তাহ আগে ব্রহ্মপুত্র নদের বন্যার পানিতে পুকুর ভেসে গেছে। আমার ধারণা প্রায় সব মাছ বের হয়ে গেছে।
উলিপুর উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের দলন গ্রামের কৃষক আবদুল লতিফ সরকার (৬৪) বলেন, ৪০ শতক জমির দুইটা পুকুরের পাড় ধসে ও পরে পানি উপচে প্রায় সব মাছ বের হয়ে গেছে। পুকুরে ২০ হাজার টাকার পোনা মাছ ছেড়েছিলাম। এখন আবার মাছের চাষ করতে পুকুর সংস্কার করা প্রয়োজন হচ্ছে।
কুড়িগ্রাম সদর সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ইসমত আরা বলেন, আমি বন্যায় ভেসে যাওয়া মাছের কিছু পুকুর পরিদর্শন করেছি। মৎস্যচাষীদের ব্যাপক ক্ষতি লক্ষ্য করেছি। এ উপজেলায় ৩০২ জন মৎস্যচাষীর ৩৯৬টি পুকুরের পোনাসহ মাছ ভেসে গেছে। তাদের মোট ক্ষতির পরিমান আনুমানিক দেড় কোটি টাকা।
ইসমত আরা জানান, বন্যা একটি প্রাকৃতিক দূর্যোগ। চাষীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমরা বিশেষ পরামর্শ দিচ্ছি। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুকুর যথাসম্ভব সংস্কার করে আবার আকারে বড় পোনা ছাড়ার পরামর্শ দিচ্ছি। এজন্য যদি তাদেরকে কোনো পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারী মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেওয়ার প্রয়োজন হয় – আমারা তাও করবো।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কালিপদ রায় জানান, আগের তথ্যানুযায়ী- এখানকার মাছচাষীরা কখনই সরকারি প্রণোদনা পাননি। বন্যার কারণে মাছচাষীদের যাতে ক্ষতি কম হয়, সে জন্য ইউনিয়ন পর্য়ায়ের মৎস্য কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তাদেরকে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকি।
”বন্যার আগে আমরা চাষিদের সতর্ক করেছিলাম। বন্যার আগাম সতর্ক করার মাধ্যমে মূলত আমরা আহরণযোগ্য মাছ তুল ফেলতে বলি। অন্যথায়, পুকুর পাড়ে নেট দিয়ে ঘিরে দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকি। আরো বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে, বস্তায় পর্যাপ্ত খাবার দিয়ে বস্তার মুখ বন্ধ করে পুকুরে রেখে দিতে বলি। ফলে অনেক মাছ খাবারের কারণে থেকে যাবে এবং কৃষকদের ক্ষতির পরিমাণ কম হবে”, যোগ করেন তিনি।
তিনি জানান, চলমান বন্যায় ৫৩১ পুকুরের মাছ ভেসে যাওয়ায় মৎস্যচাষীদের ক্ষতির পরিমান এক কোটি ৯৮ লাখ টাকারও বেশি। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা প্রস্তুত করে উর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন বলে জানা তিনি।