আমরা বাঙালীরা জাতি হিসেবেই সেই আদিকাল হতে অন্যায়ের প্রতিবাদী জাতি। সমাজ বা রাষ্ট্রে যেকোন অন্যায় হলেই তার বিরুদ্ধে আমরা প্রতিবাদে নেমে পরি যা জাতি হিসেবে অত্যান্ত গৌরব ও আনন্দের বলে ধরে নেওয়া যায়।
আমাদের ইতিহাসের পাতা খুললেই দেখা যায় বাঙালী জাতি প্রতিটি প্রতিবাদ-আন্দোলনে নিজেদের প্রাণটি দিয়ে দিতেও পিছ পা হয়নি। বিশ্বের মধ্যে আমরা এমন এক জাতি যে জাতি নিজেদের মাতৃভাষার জন্য রাজপথে জীবন বিলিয়ে দিয়েছে, নিজেদের স্বাধীনতার জন্য ৩০ লক্ষের অধিক মানুষ নিজের প্রাণটি পর্যন্ত উৎসর্গ করেছেন যার বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি,বিশ্বে মাথা উঁচু করে নিজেদের মেলে ধরেছি।
আন্দোলন সংগ্রাম প্রতিবাদ সবকিছু এখনো রয়েছে ধারাবাহিক ভাবে! কিন্ত কেনো জানি মনে হচ্ছে প্রতিবাদের পক্রিয়াটা ভিন্ন হয়ে গেলো!
প্রতিটা অন্যায় সিদ্ধান্তে বা সমাজ-রাষ্ট্রের ক্ষতি হয় এমন কাজ সম্পন্ন হলে বা আমাদের মতের অমিল হলেই রাস্তায় নেমে আসি,বিক্ষোভ মিছিল বা মানববন্ধন করি যা দিয়ে আমরা রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের মনে সংকেত দি যে এগুলো অন্যায় হচ্ছে,ততটুকু পর্যন্ত ঠিক রয়েছে।
সমস্যাটা সৃষ্টি হচ্ছে এখানেই! বর্তমানে প্রতিটা আন্দোলন সংগ্রামে আমরা অত্যান্ত নিম্নমানসিকতার পরিচয় দিয়ে দেশের বিভিন্ন জানমাল ভেঙ্গে দিচ্ছি,আগুনে জ্বালিয়ে দিচ্ছি বা নষ্ট করে দিচ্ছি যা খুবই দুঃখজনক।
আমরা যে স্থাপনা বা জানমালে আগুন দিচ্ছি-নষ্ট করছি নিজেদের উগ্রতা দেখিয়ে সে জিনিস নষ্টের জন্য ক্ষতিটা আদৌ হচ্ছেটা কার? হয়তো অনেকে বলে স্থাপনাটা রাষ্ট্রের কিন্তু স্থাপনাটা তৈরী করতে গিয়ে টাকাটা কার গিয়েছে নিশ্চয় রাষ্ট্রের নাগরিক কর্তৃক প্রদত্ত কর হতেই তৈরী হয়েছে, আর এই স্থাপনাটি নষ্ট করে কার টাকা নষ্ট করছি? অবশ্যই নিজেদের পকেটের টাকা।
তারপর বলি আমরা আন্দোলনে গিয়ে প্রথমে কি ভাঙ্গা শুরু করি? উত্তরে বলতে হয় নিজেদের সামনে পাওয়া রিক্সা,ভ্যান,সিএনজি ইত্যাদি ইত্যাদি। যা আমরা মুহুর্তের উগ্রতা দিয়ে নষ্ট করছি সেই জানমাল টায় কিন্তু একজন দিনমজুর সাধারন মানুষের সারাজীবনের স্বপ্নের বা পরিশ্রমের ফসল। আর এই জিনিসটা যখন নষ্ট করে দি তখন সেই দিনমজুর লোকটা চোখ থাকতেও পুরো দুনিয়াটাকে অন্ধকার দেখে আর নিরবে চোখের জল মোচন করে হয়তো উপরওয়ালার কাছেই বিরক্তকন্ঠে বলে কেন তুলে নিচ্ছো না তোমার ওই রাজ্যে হে উপরওয়ালা? কেন বেঁচে থেকেও মেরে পেললে আমায়! পরিবারের যে সদস্যরা আমার পকেটের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, আমি গেলেই দুমুঠো অন্ন মুখে তুলতে পারবে তাদেরকে কি উত্তরটা দিবো আমি? কি খেয়ে থাকবো আমরা? আমার শেষ সম্বলটি তো এই অমানুষ রা শেষ করে দিলো! এভাবেই নিরবে হোক আর চিৎকার করে হোক তারা আক্ষেপ করে।
বর্তমানের প্রায় প্রতিটা আন্দোলনে আমরা নিজেদের অবস্থান,শক্তি দেখানোর জন্য হলেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জানমালে আগুন দিচ্ছি, সামনে পাওয়া অসহায় মানুষটার উপার্জনের সম্বলটি ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছি। অনেকসময় তো নিজেদের উগ্রতা প্রদর্শন করতে গিয়ে সামনে থাকা মানুষের প্রাণটি পর্যন্ত নিয়ে নিচ্ছি!
আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে দাড়াতে গিয়ে কি আরেকটা অন্যায় করলাম না? একটা পরিবারের উপার্জন করার পক্রিয়াটা বন্ধ করে দিলাম না? সবাইকে অনাহারী হওয়ার পথে ঠেলে দিলাম না? সেই অসহায় ব্যক্তিদ্বয়ের অভিশাপ টা কি আমাদের উপর আসবে না?
অন্যায়ের প্রতিবাদে আন্দোলন করতে গিয়ে নিজে যদি অন্যায়কারী হই তবে সেই আন্দোলনের দরকার কি?
আমরা আদিকাল হতে যেহেতু সংগ্রামী জাতি সেহেতু আন্দোলন-প্রতিবাদ চালিয়ে নেওয়া যায় তবে এভাবে উগ্রতা দেখিয়ে অন্যের ক্ষতি করে নয়!
বর্তমানে যেভাবে প্রতিবাদ করি তার ধরণ পাল্টাতে হবে। প্রতিবাদ হবে অন্যাকারীর বিরুদ্ধে ও অসহায় নিপীড়িত মানুষের পক্ষে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে রাষ্ট হোক বা ব্যক্তিমালিকানাধীন হোক কোন জানমাল নষ্ট করা যাবে না। মনে রাখতে হবে আমার কাছে যা তুচ্ছ তাহা অন্যের কাছে মহামূল্যবান। অপরের সম্পদকে নিজের মনে করেই রক্ষা করতে হবে। আমাদের মুহুর্তের উগ্রতা যেনো অন্যের কাছে সারাজীবনের দুঃখ হয়ে না থাকে। প্রতিবাদের কারন হোক অন্যর জীবনমান সুন্দর করার প্রত্যয়ে। প্রতিবাদের ভাষা হোক সুন্দর সমার্জিত ও মৌন। প্রয়োজনে প্রতিবাদ হোক লেখনীতে।
আসুন সকলে নিজেদের উগ্রতাকে ত্যাগ করে অন্যের জীবন সুন্দর করার জন্য ও সমাজের সকল অপরাধ কে দূরীভূত করার জন্য প্রতিবাদ-আন্দোলন করি।
নিজেই নিজের কাছে শপথ নি আজ থেকে রাষ্ট্র বা কোন ব্যক্তির জানমাল নষ্ট না করি,নিজেদের উগ্রতা কে পরিহার করি।
সকলের মধ্যে শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।
লেখক: ভদন্ত বিনয়মিত্র ভিক্ষু ( নিমফুল ), তরুণ লেখক ও সমাজকর্মী