পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক ঐতিহাসিক। ধর্ম ছাড়াও দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা এবং কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা বহুদিনের। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় সৌদি আরব পাকিস্তানকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে।
এছাড়াও বিভিন্ন সময় সংকটে সৌদি আরব পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়েছে; কিন্তু নানা কারণে দুই দেশের দীর্ঘ দিনের এ সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। সম্পর্কটা এমন পর্যায় পৌঁছেছে যে, সৌদি আরব পাকিস্তানকে দেয়া তিনশ’ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধে প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছে। বাধ্য হয়ে পাকিস্তান চীনের শরণাপন্ন হয়েছে। চীন থেকে অর্থ নিয়ে পাকিস্তান এখন সৌদি আরবের ঋণ পরিশোধ করছে।
সৌদি ঋণ দফায় দফায় পরিশোধ করার কথা থাকলেও পাকিস্তান একটা পর্যায়ে এসে অপারগতা প্রকাশ করে। কারণ দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। তার ওপর করোনা মহামারীর অভিঘাত।
সৌদি চাপ সামাল দিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সেনাপ্রধান জেনারেল কামরান জাভেদ বাজওয়াকে পর্যন্ত সৌদি আরব পাঠান। কারণ বাজওয়া সৌদি আরবের পছন্দের পাত্র। এ কারণে রিয়াদ প্রথমদিকে বিষয়টি মেনে নিলেও সম্প্রতি সাফ জানিয়ে দেয়- যে কোনো উপায়েই হোক পাকিস্তানকে অর্থ ফেরত দিতে হবে। রিয়াদের এ চাপ সমাল দিতে পাকিস্তান চীনের দিকে হাত বাড়িয়েছে। এতে চীন সাড়া দিয়েছে এবং ইতোমধ্যে ২০০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে। সেই অর্থ থেকে এরই মধ্যে সৌদি ঋণের ১০০ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এটা ছিল মোট ৩০০ কোটি ডলারের দ্বিতীয় কিস্তি। এখন শেষ কিস্তি অর্থাৎ ১০০ কোটি ডলার বাকি আছে। আগামী মাসে (জানুয়ারি) সেই অর্থ শোধ করার কথা রয়েছে।
ঋণ নিয়ে এমন অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ২১ ডিসেম্বর ইসলামাবাদে নিয়োজিত সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত নাওয়াফ বিন সাঈদ আল মালিকি পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতের পর ইমরান খানের অফিস থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বৈঠকে দ্বি-পক্ষীয় সহযোগিতায় এবং কোভিড-১৯ পরিস্থিতির প্রতি জোরালো দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী ভ্রাতৃত্বপূর্ণ যে সম্পর্ক বিদ্যমান তাকে আরও শক্তিশালী করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।’ ইমরান খানের অফিসের বিবৃতিতে যাই বলা হোক না কেন, পাকিস্তান ও সৌদি আরবের সম্পর্ক যে ভালো যাচ্ছে না তা স্পষ্ট।
২০১৮ সালে পাকিস্তান ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ক্রাইসিসে’ ভুগছিল। দেশটিকে এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ৩০০ কোটি ডলার ঋণ দেয় সৌদি আরব। ওই সময় তেল খাতে আরও ৩২০ কোটি ডলার ঋণ সুবিধা দিতে সম্মত হয়েছিল সৌদি আরব কিন্তু প্রথম বছর পরে তারা তা বন্ধ করে দেয়।
সৌদি আরবের ক্যাশ লোন এরই মধ্যে পরিপক্বতা পেয়েছে। পাকিস্তান প্রত্যাশা করেছিল যে, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারীর বিষয় বিবেচনা করে রিয়াদ ঋণ শোধ দেয়ার জন্য সময় বৃদ্ধি করবে; কিন্তু তা হয়নি।
সৌদি আরবের এই রূঢ় আচরণের কারণ কী?: পাকিস্তানের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কে যে টানাপোড়েন চলছে, তার অন্যতম কারণ কাশ্মীর ইস্যুতে মাথা গলাতে সৌদি আরবের অনীহা। পাকিস্তান চেয়েছিল কাশ্মীর ইস্যুতে ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক ডেকে সৌদি আরব একটা ব্যবস্থা নেবে; কিন্তু সৌদি আরব তা করেনি। এ নিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশী সৌদি আরবের সমালোচনা করেন এবং হুমকি দেন সৌদি আরব এ ব্যাপারে ব্যবস্থা না নিলে কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের অবস্থানের পক্ষের মুসলিম দেশগুলোকে নিয়ে ইসলামাবাদ ভিন্ন পদক্ষেপ নেবে। কোরেশীর এ বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয় সৌদি আরব। এর পরই ঋণ পরিশোধে পাকিস্তানের ওপর চাপ আসে।
তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, শুধু কাশ্মীরই একমাত্র এবং প্রধান ইস্যু নয়। এর সঙ্গে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক যে মেরুকরণ শুরু হয়েছে, তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
দিল্লির জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদোয়াজের মতে, সৌদি আরব ও পাকিস্তানের সম্পর্কের টানাপোড়েনকে বৈশ্বিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে। চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডরে (সিপেক) ইরানের অন্তর্ভুক্তি এবং তাতে পাকিস্তানের সায় দেয়াটাকে সৌদি আরব একেবারেই পছন্দ করছে না। এছাড়া চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বৈরিতাকে কেন্দ্র করে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কে যে অদল-বদল চলছে, মূলত তার কারণেই পাকিস্তান-সৌদি সম্পর্কে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।
অধ্যাপক ভরদোয়াজ বলেন, সৌদি আরব আগাগোড়া যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র এবং বহুদিন ধরেই তারা ইসলামী দুনিয়ার নেতৃত্বে। কিন্তু নতুন শীতল যুদ্ধ সেই প্রচলিত ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনেছে। চীন চাইছে, ইসলামী দুনিয়ায় সৌদি আরবের প্রাধান্য খাটো হোক। ফলে দেশটি পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক, মালয়েশিয়ার ঘনিষ্ঠ হচ্ছে।’
আরেকজন বিশ্লেষকের মতে, ইসলামাবাদ যদি চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের মধ্যে ইরানকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয় এবং ইরানের চাবাহার বন্দর যদি এই করিডরের অংশ হয়, তাহলে সৌদি আরব বদলা নেবে। কারণ ইরান ও সৌদি আরবের আদর্শিক দ্বন্দ্ব ব্যাপক। ইরান শিয়া মুসলিমপ্রধান দেশ। আর সৌদি আরব সুন্নি প্রধান দেশ। এই দুই দেশ বর্তমানে ইয়েমেন, লেবানন ও সিরিয়ায় পরোক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে।
ভারত-সৌদি সম্পর্কের প্রভাব : সৌদি আরবের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। আর সৌদি আরবের বর্তমান সরকারের কাছে বাণিজ্য স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। বর্তমানে ভারত-সৌদি বাণিজ্যের পরিমাণ বছরে প্রায় ২৭০০ কোটি ডলার, যা পাকিস্তান-সৌদি বাণিজ্যের ১০ গুণ। ভারত সৌদি তেলের অন্যতম শীর্ষ আমদানিকারক। ভারতে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে সৌদি আরাব।
ফলে কাশ্মীর ইস্যুতে নাক গলিয়ে দিল্লিকে টচানোর কোনো ঝুঁকি সৌদি আরব নিতে চাইছে না। পাকিস্তান এ বাস্তবতা বুঝতে পারছে যে, চিরশত্রু ভারতের গুরুত্ব এখন সৌদি আররেব কাছে দিন দিন বাড়ছে এবং তারা কিছু চাইলে রিয়াদ তাতে সব সময় কান দেবে না। ফলে বিকল্প ভাবতে শুরু করেছে পাকিস্তান। তার কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছেন পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী শিবলি ফারাজ।
একটি আন্তর্জাতি সংবাদ মাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, যদি কোনো বিদেশ নীতিতে দেশের উদ্দেশ্য হাসিল না হয়, তাহলে নীতি-কৌশল তো বদলাতেই হবে। তিনি বলেন, কাশ্মীর ইস্যুতে অনেক দেশের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে আমাদের জাতীয় স্বার্থ মিলছে না। সেক্ষেত্রে যার সঙ্গে আমাদের জাতীয় স্বার্থ মিলবে, তাদের কাছেই তো যেতে হবে।
পাকিস্তানের এই মন্ত্রী আরও বলেন, এটা এমন একটা বিশ্ব, যেখানে বিভিন্ন দেশ তাদের জাতীয় স্বার্থে নতুন নতুন বন্ধু তৈরি করছে, জোটবদ্ধ হচ্ছে।