চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃ লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম পাপলু মানবপাচার ও অর্থপাচারের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধ ও দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হওয়ার ঘটনাটি বাংলাদেশের জন্য একটি অসম্মানজনক ও বিব্রতকর দৃষ্টান্ত। তাই সংসদের মর্যাদার স্বার্থে দ্রুত কার্যকর তদন্ত ও কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় সংসদের প্রতি দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
মঙ্গলবার (২৩ জুন) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে সংস্থাটি এ দাবি জানিয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রথম থেকেই সরকার, জাতীয় সংসদ, দুদক, ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, রাজস্ব কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এই অভিযোগের ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। উল্টো দায়মুক্তির চেষ্টার লক্ষণ দেখা গেছে।
তিনি বলেন, মানবপাচারের মতো গুরুতর অভিযোগ নিয়ে কুয়েতের সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত তথাকথিত তদন্তের পর অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে লিখিত প্রতিবেদন দিয়েছেন, যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আর আমাদের দেশের সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাতেই আশ্বস্ত থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন। জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকেও কোনো উদ্যোগের কথা জানা যায়নি। এমনকি সম্প্রতি ওই সংসদ সদস্যকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেফতার ও তার সম্পদ বাজেয়াপ্তের পদক্ষেপের সংবাদ প্রকাশের পরও সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী একাধিকবার জানিয়েছেন, কুয়েত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না জানালে তাদের কিছু করার নেই। দেশের সুনাম আর হাজার হাজার প্রবাসী শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ যেখানে জড়িয়ে আছে, সেখানে সরকারের এ ধরনের উদাসীনতা একইসঙ্গে লজ্জার ও আশঙ্কার।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কুয়েত সরকারের আনুষ্ঠানিক যোগাযোগের অপেক্ষায় না থেকে স্বপ্রণোদিতভাবে এই অভিযোগের বিরুদ্ধে তদন্ত করা সম্ভব ছিল এবং উচিতও ছিল। কেননা, যে হাজার হাজার শ্রমিককে কাজ দেওয়ার নামে পাচার করা হয়েছে এবং কার্যত জিম্মি বানিয়ে দফায় দফায় অর্থ আদায় করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, তারা সবাই এদেশেরই নাগরিক। এই পাচারের ঘটনায় দেশের ভেতরে নিশ্চিতভাবেই একটি মানবপাচার চক্র গড়ে তোলা হয়েছিল, যাতে সরকারি-বেসরকারি এক বা একাধিক ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতাও অনিবার্য। যেসব আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে, তা বাংলাদেশেও গুরুতর অপরাধ। তারপরও তদন্তের জন্য কুয়েতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে কেন? এই ঘটনাপ্রবাহ থেকে এটুকু স্পষ্ট যে, বরাবরই অভিযোগের কার্যকর তদন্তে সরকারের রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা ছিল না এবং এর পেছনে বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের দৃশ্যমান যোগসাজশ ছিল।
তিনি বলেন, এই ন্যক্কারজনক ঘটনা দেশের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের একটি দুঃখজনক দৃষ্টান্ত। অতীতে কোনো রকম রাজনৈতিক কার্মকাণ্ডে জড়িত না থেকেই ক্ষমতাসীন দলের প্রত্যক্ষ সমর্থন নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হন অভিযুক্ত সংসদ সদস্য। এরপর একরকম অভূতপূর্বভাবে তার স্ত্রীও সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসেন। কোন প্রক্রিয়ায় বা বিনিময়ে এই দম্পতি দলীয় সমর্থন বা মনোনয়ন পেলেন তা দায়িত্বশীলরা খতিয়ে দেখবেন এমনটা আমরা আশা করব।
আর আলোচ্য এই সংসদ সদস্য দম্পতির রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ দেশের জনগণের স্বার্থে, না-কি ব্যক্তিস্বার্থে জাতীয় সংসদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার জন্য- সে প্রশ্নটাও আমাদের করতে হবে। বিশেষত কুয়েতে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু হওয়ার পর তার সংসদ সদস্য স্ত্রী জাতীয় সংসদের প্যাডে যেভাবে তার স্বামীর পক্ষে সাফাই দিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন, তা রীতিমতো ন্যক্কারজনক এবং নিশ্চিতভাবেই জাতীয় সংসদের জন্য অবমাননাকর। স্পিকার আদৌ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছেন কি-না এবং সংসদ সদস্যরা বিব্রতবোধ করেছেন কি-না, সেটা আমাদের জানা নেই। সম্প্রতি লিবিয়াতে মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা যতটুকু তৎপরতা দেখিয়েছে, তার লেশমাত্র এখানে দেখা যায় না বিধায় আমরা আরও হতবাক।
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, দেশের বা ব্যক্তিবিশেষের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার অবান্তর সব অভিযোগে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতি সংবেদনশীল তৎপরতায় আমাদের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। আমরা বরাবরই তার বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান জানান দিয়েছি। আর এখন যখন এই আলোচিত সংসদ সদস্য দম্পতির কর্মকাণ্ডে দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের সম্মান সত্যিকারভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, তখন আমরা কোনো কার্যকর তৎপরতা দেখতে পাচ্ছি না।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মাত্র একদিন আগে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের লেনদেন স্থগিত করার নির্দেশ দিয়েছে। অভিযোগ আসার পর এতগুলো মাস পেরিয়ে গেল দুদকের এই পদক্ষেপটা নিতেই! আজ খবর বেরিয়েছে কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসের শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। যোগসাজশ বা দায়িত্বে অবহেলার কারণে সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য গৃহীত ব্যবস্থা কী বরাবরের মতো শুধু বদলি করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে, কি-না সেটাও আমরা জানি না।
তিনি বলেন, দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান বিবেচনায় নিয়ে, দেশ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সরকার কঠোর অবস্থান নেবে আশা করি। এবং স্পিকারের উদ্যোগে অন্তত খতিয়ে দেখা হবে, এই ঘটনা সংসদের জন্য কতটুকু অবমাননাকর। আর এর প্রতিকারই বা কী- এমনটাই আশা করে টিআইবি। অন্যথায়, একটি গণতান্ত্রিক দেশের অন্যতম মূল যে ভিত্তি, তথা আইনের শাসন, তা আরও ভূলুণ্ঠিত হবে। একইসঙ্গে রাজনীতি ও জনপ্রতিনিধিত্বে এসব অপরাধের আরও বিস্তার ঘটবে।