খুলনার রায়েরমহল মোল্লাপাড়া সড়কের দক্ষিণপাড়ার আমির শেখ (৭৫) হত্যার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ২৩ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ থাকার পর শুক্রবার (২৬ নভেম্বর) অজ্ঞাত হিসেবে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহতের স্ত্রী জামিলা বেগম বাদী হয়ে ৯ জনকে আসামী করে বটিয়াঘাটা থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার প্রধান আসামী রায়েরমহল মোল্লাপাড়ার আলোচিত মৃত দাউদ মোল্লার ছেলে মোয়াজ্জেম মোল্লা(৫৮) ও একই এলাকার মৃত মতলেব মোল্লার ছেলে মিজানুর রহমান(৫৫)কে র্যাব সদস্যরা গ্রেপ্তার করেছে।
এদিকে আকষ্মিক এ ঘটনায় আমীর শেখের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। পরিবারের সদস্যরা কোনভাবেই এমন মৃত্যু মানতে পারছে না।
নিহত আমীর শেখের স্ত্রী বিলাপ করে বলেন, গত ২৩ নভেম্বর আছর নামাজ পড়ে চায়েরপাতি ও একজনের বকেয়ার টাকা পরিশোধ করার জন্য তিনি বাড়ি থেকে বের হন। আমার কাছ থেকে একশ’ টাকা নিয়ে রায়েরমহল বড় মসজিদ বাজারে যান। তিনি আর ফিরলেন না। বাজারে গিয়ে শাক বিক্রেতার বকেয়ার টাকাও দেন। তিনি কারও ক্ষতি করেননি। শুধু জমিজমা নিয়ে যত সমস্যা। আমরা অসহায়। আমি আমার স্বামীর হত্যার বিচার চাই।
শনিবার নিহতের বাড়িতে সুনশান নিরবতা। শোকাহত পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে প্রতিবেশীসহ আশপাশ এলাকার পরিচিতজনরা। পুরো বাড়ি জুড়ে শোকাহত লোকদের ভিড়। কেউ বসে আছে, কেউ বা দাঁড়িয়ে আছে। আবার দল বেঁধে নতুন নতুন লোক আসছেন। সকাল থেকে লোকের আগমন শুরু হয় সন্ধ্যা নাগাদ জন¯্রােত ছিল ওই বাড়িতে। মাঝে মধ্যে ঘর থেকে কান্নার শব্দ বের হয়ে আসছে। যা সকল নিস্তবব্ধতাকে ভেঙ্গে দিচ্ছে। তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়নি। দেশের বাইরে অবস্থানরত বড় ছেলে শেখ জাহিদুল ফিরলে মরহুমের দাফন হবে।
নিহতের ভাগ্নি ও আনসার সদস্য নাসরিন আক্তার বলেন, গত ২৩ নভেম্বর আছরের সময় রায়েরমহল বাজারের বড় মসজিদের পাশে যান শেখ আমির হোসেন। তিনি ফিরে এলেন, তবে লাশ হয়ে। সন্ধান করা হয় সম্ভাব্য সব আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে। মাইকিং করা হয় বিভিন্ন এলাকায়। পোস্টার লাগানো হয় শহরের বিভিন্ন স্থানে তাকে জীবিত অবস্থায় ফিরে পাওয়ার জন্য। পরে তাঁর খোঁজ মেলে বটিয়াঘাটা উপজেলার নারায়নখালি গ্রামে ওহিদুজ্জামানের বাড়ির উত্তরপাশে পশুর নদীর কিনারায় ভাসমান অবস্থায় রূপসা নৌ ফাঁড়ির পুলিশ ২৫ নভেম্বর বেলা ১২টার দিকে লাশ উদ্ধার করে। তাঁকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে।
রায়েরমহল মোল্লাপাড়া ঘুরে জানা যায়, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এলাকার প্রভাবশালী। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে তখন সেই দলের পরিচয় দেন। তাদের বিরুদ্ধে জমি দখলসহ অভিযোগের অন্ত নেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের নিকট থেকে জমি বিক্রির ক্ষমতা নিয়ে তাদের কম দামে জমির মূল্য দিয়ে বিদায় দেয়ার অভিযোগও রয়েছে। এ নিয়ে কেউ বাড়াবাড়ি করলে তাদের উপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। জমির বিরোধ খুন করতে পর্যন্ত তারা দ্বিধাবোধ করে না। তাদের নামে থানায় কয়েকটি মামলাও রয়েছে।
আমীর শেখ তিন সন্তানের জনক। বড় ছেলে শেখ জাহিদুল ইসলাম দক্ষিণ আফ্রিকার সোয়াজিল্যান্ডের একটি কলেজে শিক্ষকতা করেন। ছোট ছেলে শেখ জাকিরুল ইসলাম ঢাকা পুলিশ হেড কোয়ার্টারে এআইজি’র পিএ পদে চাকুরী করেন। মেয়ে তার বসত বাড়িতে থেকে তাদের দেখাশুনা করেন। বড় ছেলে দেশের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। তিনি বাড়ি আসার পর লাশ দাফন কাফনের ব্যবস্থা করা হবে বলে ছোট ছেলে শেখ জাকিরুল ইসলাম জানান।
তিনি বলেন, ২০১০ সাল থেকে এলাকার ভূমিদস্যু খ্যাত ব্যক্তিরা তাদের চক হাসান খালি মৌজার এক একর পাঁচশতক জমি দখলে মরিয়া হয়ে ওঠে। তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করে। ছয় বছর আগেও এই জমি নিয়ে ডুমুরিয়া থানায় সালিশ হয়। সে সময় আমীর শেখকে সমস্যা না করতে ডুমুরিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ নির্দেশ দেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এরপরও বিভিন্ন উপায়ে তাকে হয়রানি করতে থাকে ওই প্রভাবশালীরা।
নিহত আমীর শেখের স্ত্রী জামিলা বেগম সরাসরি এ ঘটনার জন্য এলাকার চিহ্নিত প্রভাবশালীদের দায়ী করে বলেছেন, তাকে হত্যা করা হয়েছে। ওই দিন প্রথমে ভ্যানে ও পরে তাকে ইজিবাইকে নিয়ে হত্যা করে তার লাশ নদীতে ফেলে দিয়েছে। যা অনেকেই দেখেছে। প্রাণভয়ে কেউ মুখ খুলছে না। তাকে হাত পা ভেধে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পায়ের উরুতে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। পুলিশ লাশ পাওয়ার পরও নিয়ম না মেনেই গোপনে দাফনের চেষ্টা করে। যা লাশ গুম করার চেষ্টা বলে তিনি মনে করেন।
বাটিয়াঘাটা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ শাহ জালাল জানান, নিহতের স্ত্রী জামিলা বেগম বাদী হয়ে ৯ জনকে আসামী করে বটিয়াঘাটা থানায় মামলা দায়ের করেছেন। মামলাটি রূপসা নৌ ফাঁড়ির পুলিশের ইনচার্জ (ওসি) মোঃ আঃ মুন্নাফ তদন্ত করছেন বলে তিনি জানান। মামলার প্রধান আসামী রায়েরমহল মোল্লাপাড়ার আলোচিত মোয়াজ্জেম মোল্লা(৫৮) ও একই এলাকার মিজানুর রহমান(৫৫)কে র্যাব সদস্যরা শনিবার (২৭ নভেম্বর) বিকেলে গ্রেফতার করেছে বলে তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, তাদের সহযোগিতায় র্যাব সদস্যরা তাদের দু’জনকে গ্রেফতার করে তাদের হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।