চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃরাষ্ট্রায়ত্ত সব পাটকলের উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। গত ২৮ জুন এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই ঘোষণা দেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। ফলে একসঙ্গে ২৫টি সরকারি পাটকলের উৎপাদন বন্ধ হওয়ায় সরাসরি ২৪ হাজারের বেশি শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ হওয়ার কারণে বিদেশে পাটের বাজারে এর খুব বেশি প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন পাট ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা। সরকারও মনে করে, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের উৎপাদন বন্ধ হওয়াতে বিদেশের বাজারে তেমন প্রভাব পড়বে না।
এ প্রসঙ্গে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রউফ বলেন, রফতানি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর অবদান মাত্র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। বাকি সবই (৯৫ দশমিক ৪ শতাংশ) রফতানি করে বেসরকারি পাটকলগুলো। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের উৎপাদন বন্ধ হওয়ায় বিদেশের বাজারে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। তিনি বলেন, বিজেএমসি উৎপাদনে না থাকায় ওই স্থান অন্যদের দখল করতে হয়তো কয়েক মাস লাগবে। তিনি উল্লেখ করেন, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো উৎপাদনে থাকাকালেই অবদান ৩০ শতাংশ থেকে কমতে কমতে সর্বশেষ এখন ৪ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। আর সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে বেসরকারি খাত। বর্তমানে পুরো পাট সেক্টরে বেসরকারি খাতের অবদান ৯২ শতাংশ। আর বিজেএমসি’র অবদান মাত্র ৮ শতাংশ বলেও জানান তিনি।
পাট ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএ) সভাপতি শেখ সৈয়দ আলী বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো আগের মতো বিদেশের বাজারে প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। ফলে এই পাটকল বন্ধ হওয়াতে বিদেশে পাটের বাজারে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। এছাড়া তিন মাস পরেই যেহেতু রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল আবার চালু হওয়ার কথা, সে কারণে বিদেশের বাজারে কোনও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই।
উল্লেখ্য, বিজেএমসির অধীন এতদিন ২৫টি পাটকল চালু ছিল। এর মধ্যে ২২টি পুরোদমে পাটকল ও ৩টি নন-জুট ইন্ডাস্ট্রি। পাটকলগুলোয় বর্তমানে স্থায়ী শ্রমিক আছেন ২৪ হাজার ৮৮৬ জন। এছাড়া তালিকাভুক্ত বদলি ও দৈনিক ভিত্তিক শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার।
সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ ঘোষণার আগে থেকেই বিদেশে পাটের বাজার বেসরকারি খাতের দখলে রয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. জাহিদ মিয়া। তিনি বলেন, মূলত বেসরকারি পাটকলগুলোর উৎপাদিত পণ্য বিদেশের বাজার ধরে রেখেছে। রফতানির ক্ষেত্রে বর্তমানে ৯৫ শতাংশই বেসরকারি পাটকলগুলোর অবদান। বেসরকারি উদ্যোক্তারা একটু সিরিয়াস হলে বাকি ৫ শতাংশও কাভার করতে পারবে। ফলে সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ হওয়াতে বিদেশের বাজারে কোনও প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, সরকারি পাটকল বন্ধ হওয়াতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের অনেকেই তাদের বন্ধ থাকা পাটকল চালু করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাবে। ফলে মাত্র ৫ শতাংশ কাভার হতে বেশিদিন সময় লাগবে না।
তবে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ করার কারণে বড় বড় অর্ডার কমে যাওয়ার আশঙ্কা করেছেন অনেকেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শীর্ষ পাট ব্যবসায়ী বলেন, ২৪টি পাটকল একটি ম্যানেজমেন্টের অধীনে থাকায় বড় বড় অর্ডার বিজেএমসির কাছে আসতো। রাষ্ট্রায়ত্ত সব পাটকল বন্ধ হওয়াতে সেই অর্ডার হয়তো কমে যাবে। তবে বেসরকারি খাতে এখন পাটের প্রচুর মিল ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে। ফলে বিদেশের বাজারের যে চাহিদা, সময় কিছুটা লাগলেও তা হয়ত মেটানো যাবে।
জানা গেছে, বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে ভারত, সিরিয়া, ইরান, মিসর, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, থাইল্যান্ড, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্য।
এদিকে একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ হলেও বেসরকারি খাতে পাটকলের সংখ্যা বাড়ছে। গতবছর পর্যন্ত জুট স্পিনিং মিলসহ সব মিলিয়ে আড়াইশ পাটকল রয়েছে। এর মধ্যে ৫৫টি সরকারের কাছ থেকে নিয়েছে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। তবে এই ৫৫টির মধ্যে মাত্র ৫টি চালু আছে। বাকি ৫০টিসহ প্রায় ১০০টি বেসরকারি খাতের পাটকল এখন বন্ধ রয়েছে।
এদিকে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে রফতানি ১৭ শতাংশ কমলেও এই মন্দা অবস্থার মধ্যে পাট রফতানি বেড়েছে। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার আয় করেছে। যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ৭ শতাংশ। ইপিবি’র তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের নয় মাসে অর্থাৎ জুলাই-মার্চ পর্যন্ত পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানিতে ২৫ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি ছিল।
জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পাট খাতে বিশেষ করে কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানির মাধ্যমে আয় ছিল ৬ হাজার ৪১৮ কোটি ৭২ লাখ টাকা। যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ২৯০ কোটি ৪০ লাখ টাকায়। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এটি আরও বেড়ে ৭ হাজার ৬৮৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা দাঁড়ায়। অন্যদিকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮ হাজার ৯৬ কোটি ২১ লাখ টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আয় হয় ৬ হাজার ৭৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার বা ৭ হাজার ৪১ কোটি ১৩ লাখ টাকা আয় করেছে।
পাট অধিদফতরের তথ্যমতে, পাট খাতের রফতানি আয়ে এখন সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে পাটজাত পণ্য। একসময় কাঁচা পাটের অবদান খুব ভালো হলেও ক্রমেই তা অবনতি হচ্ছে। পাশাপাশি বৈশ্বিক কাঁচা পাটের বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে। সেখানে পাটজাত পণ্য বেশ ভালো করছে।
বর্তমানে সারাদেশে ৮০ লাখ বেল কাঁচা পাট উৎপাদন হচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৭৩ লাখ ১৫ হাজার বেল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ লাখ ২৫ হাজার বেল রফতানি হলেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে হয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার বেল। যদিও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কাঁচা পাট রফতানির পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ১ হাজার বেল।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্র বলছে, স্বাধীনতার প্রথম ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে রফতানি আয়ের ৯০ শতাংশই ছিল পাটের অবদান। বর্তমানে রফতানি খাতে পাটের অবদান ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে ব্যক্তি মালিকানাধীন ও পরিত্যক্ত পাটকলসহ সাবেক ইপিআইডিসির ৬৭টি পাটকল তদারক, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বিজেএমসি গঠিত হয়। পরে আরও পাটকল সরকারি করে বিজেএমসির আওতায় আনা হয় মোট ৮২টি পাটকল। কিন্তু ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ৪৩টি পাটকলকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পর সরকারের হাতে থাকে ৩৮টি পাটকল। ১৯৯৩ সালে বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শে পাট খাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় আরও ১১টি পাটকল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এশিয়ার বৃহত্তম আদমজী জুট মিল বন্ধ হয়ে যায় ২০০২ সালে। বর্তমানে সরকারের হাতে ২৫টি পাটকল রয়েছে।