করোনার প্রভাবে বেকার হওয়া রফতানিমুখী শিল্প শ্রমিকদের সহায়তা দিতে যে তালিকা হয়েছে, এর অর্ধেকের বেশিই জাল। জাতীয় পরিচয়পত্র ও প্রতিষ্ঠানের নিয়োগপত্রের নাম, নম্বর অথবা ব্যাংক হিসাবের সঙ্গে গরমিল থাকায় সংশ্লিষ্টদের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। পুনরায় তালিকা করার নির্দেশ দিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিতে এসব ভুয়া নাম অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতেরও পরামর্শ দেন তারা।
গত মার্চ থেকে শুরু হওয়া করোনার প্রভাবে রফতানিমুখী অনেক শিল্পের শ্রমিকরা চাকরি হারিয়েছেন। বেকার হয়ে অনেকে ফিরে গেছেন নিজ গ্রামে। এসব বেকার ও কর্মহীন শ্রমিককে সহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। রফতানিমুখী তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্পের কর্মহীন ও দুস্থ শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে মোট ১১৭০ কোটি টাকা (১১৩ মিলিয়ন ইউরো) অনুদান দেয় ইইউ।
এর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রদান করবে ৯৩ মিলিয়ন ইউরো এবং ফেডারেল জার্মান সরকার প্রদান করবে অবশিষ্ট ২০ মিলিয়ন ইউরো। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সাপোর্ট টু ন্যাশনাল সোশ্যাল সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজি রিফর্ম ইন বাংলাদেশ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে রফতানিমুখী তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্পের প্রায় ১০ হাজার কর্মহীন শ্রমিকের জন্য মাসিক ৩ হাজার টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। উপকারভোগী একজন শ্রমিক সর্বোচ্চ তিন মাস আর্থিক সহায়তা পাবেন। অনুদানের অর্থ সরাসরি দুস্থ শ্রমিকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা মোবাইল ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রদান করা হবে।
এরপর সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের কাছ থেকে কর্মহীন বেকার শ্রমিকদের নামের তালিকা চাওয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে বিজিএমইএ, বিকেএমই, ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন সাত হাজার ৩৯০ জন শ্রমিকের তালিকা চূড়ান্ত করে। পরে এ তালিকা শ্রম অধিদফতরে পাঠায়। সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ৩ হাজার ২৬৬ জন প্রকৃত শ্রমিক পাওয়া যায়। আর ভুয়া চিহ্নিত হয় ৪ হাজার ১২৪।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, বেকার শ্রমিকদের তালিকা তৈরি করতে যে সংগঠনগুলো ভুল করল, সেটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কি না, তা জানতে জবাবদিহিতায় আনতে হবে। কারণ, তালিকা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন কাজ করছে।
তাদের কাছে তথ্যভাণ্ডার আছে-এমন কথা তারা সব সময় বলে আসছে। তাদের ভুল হওয়ার সুযোগ নেই। ফলে এ ধরনের ভুল গ্রহণযোগ্য নয়। তালিকা প্রণয়নে কেন ভুল হল, এর পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল কি না, অর্থ আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে এটি করা হয়েছে কি না-তা তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা বের করা দরকার। সেখানে কেউ দায়ী থাকলে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া উচিত।
এই কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মো. রেজাউল হক যুগান্তরকে বলেন, চারটি সংগঠনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তালিকা যাচাই-বাছাই করেছে শ্রম অধিদফতর। তালিকায় ব্যাপক গরমিল পাওয়া গেছে। তালিকায় কর্মহীন শ্রমিকের নিয়োগের সময় যে ভোটার আইডি কার্ড প্রদর্শন করেছে, ওই আইডি কার্ডের সঙ্গে তালিকায় বেশিরভাগ নামের আইডির সঙ্গে গরমিল পাওয়া গেছে।
এ প্রসঙ্গে শ্রম অধিদফতরের মহাপরিচালক একেএম মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, রফতানিমুখী চারটি শিল্প সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে কর্মহীন বেকার ৭৩৯০ শ্রমিকের নামের তালিকা পাঠানো হয়। অনুমান করা হয়েছিল পুরো তালিকা ঠিক আছে; কিন্তু পরে ভোটার আইডি কার্ড নম্বর যাচাই-বাছাই করে সঠিক পাওয়া গেছে ৩ হাজার ২৬৬ জনের নাম। বাকিদের ভোটার আইডির সঙ্গে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের আইডির মিল পাওয়া যায়নি।
সূত্র আরও জানায়, এই কর্মসূচির আওতায় প্রকৃত যে শ্রমিকদের আইডি নম্বর মিল পাওয়া গেছে তাদের নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। বাকিদের নাম-ঠিকানা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হিসাব ও ভোটার আইডি কার্ড নম্বর মিলিয়ে পুনরায় তালিকা পাঠাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে শ্রম অধিদফতর থেকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিকেএমইএ সহসভাপতি মো. হাতেম যুগান্তরকে বলেন, শিল্পকারখানায় নিয়োগের সময় অসৎ উদ্দেশ্যে অনেক শ্রমিক ফলস ভোটার আইডি নম্বর দিয়ে থাকে। কাজের চাপের মধ্যে তাদের নিয়োগপত্র দেয়া হয়, যা পরে ভুয়া ধরা পড়ে। তবে তালিকায় কোনো শ্রমিকের নাম ভুল দেয়া হলে তাকে এই নগদ কর্মসূচির আওতায় কোনো অর্থ দেয়া হবে না। প্রকৃত শ্রমিকরাই এ সুবিধা পাবে। কেউ ভুয়া আইডি কার্ড ব্যবহার করে থাকলে, শনাক্ত করে শাস্তি দেয়া উচিত।
সূত্রমতে, পাদুকা শিল্পের পক্ষে বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন এই কর্মসূচির জন্য তাদের ২০০ শ্রমিকের নামের তালিকা দিয়েছে। এর একটিও সঠিক পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন যুগান্তরকে বলেন, শ্রমিক অধিদফতর থেকে বেকার শ্রমিকদের তথ্য চাওয়ার পাশাপাশি অনেক কঠিন শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এসব শর্ত পূরণ করা কঠিন। অনেক প্রতিষ্ঠান এসব তথ্য সংরক্ষণে রাখে না। তিনি বলেন, আমাদের পাঠানো তালিকার বিষয় শ্রম অধিদফতর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো কিছু জানায়নি।
প্রকৃত বেকার শ্রমিকদের কিছু নামের তালিকা নিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর এই কর্মসূচি উদ্বোধন করেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান। মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, এই কর্মসূচি প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে উদ্বোধনের পরিকল্পনা ছিল; কিন্তু বেকার শ্রমিকদের ত্রুটিপূর্ণ তালিকার কারণে সীমিত পরিসরে এই কর্মসূচি উদ্বোধন করা হয়।