খুলনা: বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে হরিণ শিকারিরা। তারা বনের মধ্যে ফাঁদ পেতে ও গুলি করে চিত্রা ও মায়া হরিণ শিকার করছে।
জানুয়ারি মাসের শেষ ১০ দিনের মধ্যে সুন্দরবন থেকে শিকার করা ১৯টি হরিণের চামড়া, ৬৩ কেজি মাংসসহ ১০ জন চোরা শিকারি ও বন্যপ্রাণির চামড়া আটক করেছে সুন্দরবন বিভাগ, কোস্টগার্ড ও পুলিশ সদস্যরা।
সুন্দরবনে যে অঞ্চলে কেওড়া গাছ বেশি সেখানে হরিণের বিচরণ বেশি। সংঘবদ্ধ চোরা শিকারিরা সুন্দরবনের গহীনে সেসব স্থানে অবস্থান নিয়ে নৌকা, ট্রলার ও গাছে মাচা পেতে হরিণের গতিবিধি লক্ষ্য করে। হরিণ নদী ও খালের চরাঞ্চলে ঘাস খেতে আসে। শিকারিরা এসব স্থানে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে। কখনো তারা গুলি ছুড়েও শিকার করে। পরে গোপন আস্তানায় মাংস তৈরি করে সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে। সুন্দরবন সংলগ্ন মোংলা, শরণখেলা, কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছাসহ বনের আশপাশ এলাকায় সবচেয়ে বেশি হরিণের মাংস পাওয়া যায়। এভাবে হরিণ শিকার করে বিক্রি করতে গিয়ে অনেকে ধরাও পড়েন আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে।
সবশেষ শনিবার (৩০ জানুয়ারি) গভীর রাতে মোংলা উপজেলার দিগরাজ বাজার সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি হরিণের মাথা ও ৪৭ কেজি মাংসসহ তিন চোরাকারবারিকে আটক করে কোস্টগার্ড সদস্যরা। এসময় তিনটি মোবাইল ফোন, একটি হরিণের মাথা, ভুড়িসহ ৪৭ কেজি মাংস জব্দ করে কোস্টগার্ড।
আটক ব্যক্তিরা হলেন- খুলনা জেলার দাকোপ উপজলার ঢাংমারী গ্রামের আবু সরদারের ছেলে মোনা সরদার (৩২), বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলার বন্নি গ্রামের জাফর শেখের ছেলে জাহিদ শেখ (৩৮) ও মোংলা উপজেলার দক্ষিণ কানমারি গ্রামের মোহাম্মাদ আলীর ছেলে মো. শহিদুল (৪০)।
শুক্রবার (২২ জানুয়ারি) রাত পৌনে দুইটার দিকে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলা সদরের ব্র্যাক অফিসের সামনে থেকে সুন্দরবন থেকে শিকার করে আনা হরিণের ১৯টি চামড়াসহ দুই পাচারকারীকে আটক করে জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
আটক ব্যক্তিরা হলেন- বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার রাজৈর গ্রামের মো. মতিন হাওলাদার ওরফে মতি কাজীর ছেলে মো. ইলিয়াস হাওলাদার (৩৫) ও বাগেরহাট সদর উপজেলার ভদ্রপাড়া গ্রামের মো. মোশারেফ শেখের ছেলে মো. মনিরুল ইসলাম শেখ (৪৮)।
মনিরুল ইসলাম বর্তমানে শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বসবাস করেন। তার বাসার পাটাতন থেকে এই চামড়া উদ্ধার করে পুলিশ।
সোমবার (২৫ জানুয়ারি) দিবাগত রাত ১টার দিকে খুলনার দাকোপ উপজেলার পানখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে স্থানীয় মাসুদের দোকানের সামনে রাস্তার ওপর সুন্দরবন থেকে শিকার করে আনা হরিণের ১১ কেজি মাংসসহ দুইজনকে আটক করে থানা পুলিশ।
এর আগে রোববার (২৪ জানুয়ারি) উপজেলার কৈলাশগঞ্জ ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের ধোপাদী গেটের পাশে গভীর রাতে অভিযান চালিয়ে ওই গ্রামের পাকা রাস্তার ওপর থেকে হাতেনাতে সাড়ে চার কেজি হরিণের মাংসসহ তিন পাচারকারীকে আটক করে।
আটক শিকারিরা হলেন- খুলনার খানজাহান আলী থানার আটরা-পালপাড়া এলাকার খান খোলজার আহম্মদের ছেলে খান মুজিবুল সুলতান (৩৩), একই থানার মসিয়ালী এলাকার আয়নাল ফকিরের ছেলে মো. টিটু হোসেন (২৪), চট্টগ্রামের মিরসরাইরের বরাইয়া গ্রামের মুন্সি মোস্তফার ছেলে রুহুল আমনি (৫৬), রাঙ্গামাটির নানিয়াচরের ইসলামপুর গ্রামের আলী আকবর হাওলাদারের ছেলে আ. সোবহান (৬৫) ও খুলনার দাকোপ উপজেলার রামনগর গ্রামের জিতেন্দ্র নাথ রায়ের ছেলে কুমারেশ রায় (৫৫)।
অভিযোগ রয়েছে, বনদস্যুরা এখন তুলনামূলকভাবে কম সক্রিয়, কিন্তু হরিণ শিকারিদের চক্রগুলোর উৎপাত সুন্দরবনে বেড়েছে বেপরোয়াভাবে। শিকারিদের ধরতে সুন্দরবনে স্মার্ট প্যাট্রল এবং বন বিভাগের টহল থাকলেও অদৃশ্য কারণে শিকার কমছে না। বনবিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে আবার কখনো এদের চোখ ফাঁকি দিয়ে চুরি করে বনে ঢুকে শিকারিরা ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে। পরে বিভিন্ন কৌশলে এ হরিণের মাংস খুলনা-বাগেরহাট এমনকি ঢাকায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে নানা দামে। তবে বেশি দামে বিক্রি হয় চামড়া। আর এভাবে বিক্রি করতে গিয়ে মাঝে মধ্যে পথে ঘাটে ধরা পরে দুই এক জন শিকারি। ধরা পড়া দুই একজন ব্যক্তিকে ছেড়ে দিয়ে অর্থ বাণিজ্য করে কিছু অসাধু বন কর্মকর্তা ও পুলিশ। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা ও জনপ্রতিনিধি এ সব শিকারি চক্রের কাছ থেকে হরিণের মাংসসহ আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করায় দিন দিন সুন্দরবনে হরিণ শিকার বেড়ে যাচ্ছে।
অনেকে বলছেন, আগে একসময় সুন্দরবনে অহরহ হরিণ শিকার চলত। বন বিভাগ এবং আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর তৎপরতায় মাঝে হরিণ শিকার অনেক কম ছিল। কিন্তু সম্প্রতি সময়ে হরিণ শিকার বেড়েছে।
সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক ও সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) খুলনার সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বাংলানিউজকে বলেন, বন্যপ্রাণী শিকার নিষিদ্ধ হলেও আইন অমান্য করে হরিণ শিকার করছে একটি চক্র। এতে সুন্দরবনে দিন দিন কমে যাচ্ছে হরিণের সংখ্যা। সম্প্রতি সময়ে হরিণ শিকার বেড়ে যাওয়া আমাদের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। যেখানে বনদস্যু আটক হয়ে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হচ্ছে। সেখানে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার বেড়ে যাচ্ছে। এর পেছনে বনবিভাগ ও আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে বলে মনে করছেন তিনি।
হরিণ শিকার বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপ বন সংরক্ষক মো. কবির হোসেন পাটোয়ারী বাংলানিউজকে বলেন, আমি একটু বাইরে আছি। আমার সামনে লোক রয়েছে। পরে এ বিষয়ে কথা বলবো।
রোববার (৩১ জানুয়ারি) বিকেলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার বাংলানিউজকে বলেন, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদক ব্যবসায়ীদের মোটরসাইকেল বা গাড়ি নিয়ে ধরতে পারে। কিন্তু বনের মধ্যে তা সম্ভব না। বিস্তীর্ণ বনের প্রত্যেকটি খালের আলাদা আলাদা বনরক্ষী দিতে পারলে হয়তে বা হরিণ শিকার কমে যেত। মানুষের নৈতিকতার অবক্ষয় হয়েছে। শিকারি ধরা পড়লে মামলা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু দুই দিন পর আদালত থেকে তারা জামিন নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে।