সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি নমুনা আসায় ফল দিতে দেরি হচ্ছে। তৈরি হয়েছে নমুনার স্তুপ। এতে দিনাজপুরে স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
চ্যানেল খুলনা ডেস্কঃদিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পিসিআর ল্যাব থেকে করোনাভাইরাসের নমুনার ফল আসতে ১৬ দিন পর্যন্ত সময় লাগছে। আবার একই ব্যক্তির নমুনা অন্য কোথাও নেগেটিভ আসলেও দিনাজপুর মেডিকেলে পজিটিভ আসারও অভিযোগ করা হয়েছে। এতে স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি নমুনা আসায় ফল দিতে দেরি হচ্ছে। তৈরি হয়েছে নমুনার স্তুপ। পিসিআর ল্যাবের সংখ্যা বাড়ালে সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করছেন তারা। তবে রিপোর্ট নেগেটিভ-পজিটিভ নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তারা বলছেন, ”এটা অস্বাভাবিক নয়।”
দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার সাংবাদিক ধীমান দাস। গত ৮ জুন তার শরীরে করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেয়। এ অবস্থায় গত ১৩ জুন তিনি করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা প্রদান করেন। ১৫ দিন পর গত ২৮ জুন দিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজের ল্যাব থেকে তার প্রতিবেদন আসে ‘করোনা পজিটিভ’।
ধীমান দাস বলেন, করোনার নমুনা দেওয়ার পর আমি সুস্থ হয়ে যাই। তারপরও গত ২০ জুন পর্যন্ত আমি হোম কোয়ারেন্টিনে ছিলাম। এরপর সুস্থ হয়ে যাওয়ায় ও শরীরে কোনো সমস্যা না থাকায় আমি বাড়ি থেকে বাইরে বের হয়েছি।
”তবে গত ২৮ জুন করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসার পর আমার বাড়ি লকডাউন করা হয়। অথচ এখন আমি সম্পুর্ণ সুস্থ, কোনো সমস্যা নেই।” নমুনার ফল সঠিক সময়ে না আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি।
শুধু ধীমান দাসই নয়, একই দিন নমুনা দিয়েছিলেন জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার নশরতপুর ইউপি চেয়ারম্যান এ এইচ নুর ইসলাম শাহ, তার স্ত্রী ইসমত আরা, ছেলে ইশফাফ ইসলাম নাঈমসহ পরিবারের পাঁচজন। করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট আসতে দেির হওয়ায় ১৯ জুন সৈয়দপুর ক্যান্টমেন্টের বুথে নমুনা দেন তিনি। কয়েকদিন পর সেখান থেকে রিপোর্ট আসে ‘করোনা নেগেটিভ’।
অথচ নমুনা দেওয়ার ১৬ দিন পর দিনাজপুর মেডিকেল থেকে গত ২৯ জুন দেওয়া রিপোর্টে তিনিসহ পরিবারের চার সদস্যের রিপোর্ট আসে ‘করোনা পজিটিভ’।
চেয়ারম্যান নুর ইসলাম শাহ বলেন, দিনাজপুর এম. আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ থেকে দেওয়া রিপোর্টে আমিসহ পরিবারের চারজনের করোনা পজিটিভ এসেছে। অথচ সিএমএইচ-এ থেকে আমার রিপোর্ট এসেছিল নেগেটিভ।
”আমরা সবাই সুস্থ আছি, সন্দেহের বশত নমুনা দিয়েছিলাম। এত দেির করে যদি রিপোর্ট আসে তাহলে রোগী বাঁচবে না কি মরবে তার কোনো ঠিক নেই”, যোগ করেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে দায়িত্বরত একজন সেবিকা বলেন, গত ২১ জুন ডিউটি পালন করার সময় আমার জ্বর ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। ওই দিনই বেলা ১১টায় নমুনা দেই। আমার সঙ্গে যিনি কাজ করতেন তার রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে।
”কিন্তু এখন পর্যন্ত আমার রিপোর্ট দেওয়া হয়নি। সিভিল সার্জন অফিসেও খোঁজ নিয়েছি, সেখানেও নেই।”
জেলার বোচাগঞ্জ উপজেলার মুজাটিবাজার চাপাইপুর গ্রামের রাজেন্দ্রনাথ রায় গত ১৬ জুন নমুনা দিয়েছিলেন। ১৩ দিন পর ২৯ জুন তার রিপোর্ট এসেছে করোনা পজিটিভ। তবে এর আগেই তিনি সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন দাবি করে বলেন, ”এর মধ্যে আমি মাঠে কাজ করতে গিয়েছি। মানুষের সঙ্গে চলাফেরা করেছি।
ঘোড়াঘাট উপজেলার সিংড়া রামেশ্বরপুর দক্ষিণপাড়া গ্রামের মাহমুদুল হাসান। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনার নমুনা দিয়েছিলেন গত ১৬ জুন। ১৩ দিন পর ২৯ জুন তার রেজাল্ট আসে করোনা পজিটিভ।
তিনি বলেন, যখন আমার রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে তখন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। পরদিন জেলার শেখ ফজিলাতুন্নেছা হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা করেছিলাম। রিপোর্ট আসে নেগেটিভ। কিন্তু এরই মধ্যে আমার বাসা লকডাউন করা হয়েছি।
দিনাজপুরে নমুনা দেওয়ার পর ১০-১৫ দিন পার হয়ে গেলেও ফল না আসার অভিযোগ অনেকের। তারা বলছেন, নমুনা দেওয়ার পর ফল আসতে যতদিন সময় লাগছে, আক্রান্ত হলেও ততদিনে তারা সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সুস্থ হওয়া সত্ত্বেও তাদের বাড়ি লকডাউন করা হচ্ছে। সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে।
খানসামা উপজেলার সাংবাদিক ধীমান দাস বলেন, নমুনা দেওয়ার ১৫ দিন পর যখন আমি সুস্থ তখন আমাকে ঘরবিন্দ থাকতে বলা হয়। কিন্তু যখন আমি সুস্থ তখন কেন ঘরের ভেতর থাকব। রেজাল্ট দেরিতে এসেছে। এখানে আমার কী দোষ?
”যখন করোনার রেজাল্ট এলো তখন আশপাশের সবাই আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিল। এমনকি আমার সঙ্গে যারা চলতো তাদের সঙ্গে কেউ কথা বলছে না। তাদেরকে দেখে সবাই দূরে চলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আমি অন্যায় করেছি”, বলেন তিনি।
দিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের আরটি-পিসিআর ল্যাবে দায়িত্বরত একজন স্বাস্থ্যকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রিপোর্টগুলো দ্রুত দেওয়ার চেষ্টা আমাদের রয়েছে। এখানে ২৪ ঘণ্টায় ১৮৮টি নমুনা পরীক্ষা করা যায়।
”কিন্তু পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলা থেকে প্রতিদিন ৩০০ থেকে সাড়ে ৩৫০টি নমুনা আসে। আমরা সিরিয়াল মোতাবেক সবগুলো নমুনাই পরীক্ষা করি। কিন্তু সক্ষমতার অভাবে সবগুলো নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হয় না।”
দিনাজপুর জেলা করোনা কন্ট্রোল রুম সহকারী ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. শাহ মো. এজাজ উল হক বলেন, ওই চেয়ারম্যানের দুটি রিপোর্টই সঠিক। যেহেতু তিনি ১৩ জুন নমুনা দিয়েছেন ওই সময়ে তার শরীরে করোনাভাইরাস ছিল। কিন্তু এরপরে ১৯ তারিখে তিনি যে নমুনা দিয়েছিলেন তখন তার শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি না থাকার কারণে রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে।
”যেহেতু মেডিকেল কলেজে ১৩ জুন নমুনা দিয়েছিলেন তাই তার নমুনায় পজিটিভ এসেছে। এটি খুবই সাধারণ ঘটনা”, বলেন ডা. শাহ এজাজ।
দিনাজপুর সিভিল সার্জন ডা. আবদুল কুদ্দুছ বলেন, গত ১৪ এপ্রিল দিনাজপুরে প্রথম করোনা পজেটিভ রিপোর্ট আসে। দিনাজপুরসহ মোট চারটি জেলার সকল স্থান থেকে এই ল্যাবে নমুনা আসে। প্রতিদিন দুই শিফটে ১৮৮টি নমুনা পরীক্ষা হয়। তাই দেখা যায় সপ্তাহ শেষে ৮০০ থেকে ১০০০ নমুনা সংরক্ষিত থাকে। এ কারণে রিপোর্ট আসতে বেশি সময় লাগে।
ল্যাবের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হলে এ সমস্যার সমাধান হবে বলে জানান তিনি।